সদগুরু : “কালারিপায়াত্তু” হল সম্ভবত এই গ্রহের প্রাচীনতম মার্শাল আর্ট বা শরীরকে ব্যবহার করে লড়াই করার যুদ্ধকলা। এর বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলতে হয় তা হল, এটি অগস্ত্য মুনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন। কারণ মার্শাল আর্ট মানে শুধুই লাথি আর ঘুসি মারা কখনই নয়। শরীরকে সম্ভাব্য সব রকম ভাবে ব্যবহার করার কৌশল শেখায় এই কলা। এই কলার উদ্দেশ্য শুধু শরীরচর্চার ব্যায়াম শেখানো এবং শরীরের মধ্যে চলাফেরার সাবলীল দ্রুততা (Agility) নিয়ে আসাই নয়, বরং শরীরের অভ্যন্তরীণ শক্তিতন্ত্র (Energy System)-এর এক সঠিক ধারণা অর্জন করাও। “কালারি চিকিৎসা” ও “কালারি মর্ম” - এই বিষয় দুটির মাধ্যমে শরীরের নানান গূঢ় রহস্য জানা যায় এবং শরীরের কোষের পুনরুজ্জীবন করার ক্ষমতাকে সক্রিয় রাখার মাধ্যমে শরীরকে দ্রুত সারিয়ে তোলার এক অবস্থায় রাখা যায়। হয়ত, এই ব্যাপারে যথেষ্ট সময় উৎসর্গ করেন বা যথেষ্ট মনোযোগ দেন এমন কালারি অনুশীলনকারী খুব কম সংখ্যকই আজকের দিনে আছেন, কিন্তু আপনি যদি যথেষ্ট গভীরে যেতে পারেন, তবে আপনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই যোগ এর অভিমুখেই এগোবেন, কারণ, অগস্ত্য মুনির থেকে আসা কোনও কিছুই আধ্যাত্মিক বিষয় ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারেনা। তিনি আধ্যাত্মিক তত্ত্ব অনুসন্ধানের জন্য যত রকম উপায় সম্ভব, প্রায় সেই সব রকম রাস্তাই খুলে দিয়েছিলেন।
শরীরের এমন বহু অনাবিষ্কৃত মাত্রা রয়েছে, যা এখনো আমাদের অজানাই রয়ে গ্যাছে। এমন অনেক কারাটে মাস্টাররা আছেন, যারা শুধু আপনাকে সামান্য ছুঁলেই আপনাকে মেরে ফেলতে পারেন। কাউকে শুধু একটু ছুঁয়েই মেরে ফেলা - এটা তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু সামান্য এবারের স্পর্শে আবার কাউকে বাঁচিয়ে তোলা - এটা একটা বিরাট ব্যাপার।
আমরা যদি শুধুমাত্র মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা করতাম, তাহলে ব্যাপারটা অনেক সহজ হত। মানুষের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটানোটা আমার মতে তেমন বিশেষ কোনও কঠিন কাজই নয়। কিন্তু আমরা চাইছি মানুষের জীবনের অতীন্দ্রিয় স্তরগুলোর দরজাকেও খুলে ধরতে। সেক্ষেত্রে একেবারে ভিন্ন মাত্রার একাগ্রতা আর নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার মানসিকতা প্রয়োজন। প্রকৃতির বেঁধে দেওয়া সীমানার বাইরে গিয়ে জীবনকে জানতে হলে একেবারে অন্য ধরণের মানুষ হতে হয়। ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষই, এমনকি নিজের শরীরকেও কখনও সম্পূর্ণ জানার চেষ্টা না করেই মরে যান। অথচ, যদি আপনি এই শরীরটাকেও একটু জানার বা চেনার চেষ্টা করেন, তাহলে এই শরীর অসামান্য কাজ করতে পারে , শুধু এখানে বসে বসেই। এই হল যোগের পদ্ধতি। “কালারি” হল এরই আরও গতিময় একটা রূপ।
“কালারি” এর উদ্ভব হয়েছিল বন্য জীবজন্তুদের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য
“মার্শাল আর্ট” এর উদ্ভব মূলত হয়েছিল দক্ষিণ ভারতেই। অগস্ত্য মুনি খর্বদেহ ও ক্ষুদ্রকায় হলেও অবিশ্রাম ভ্রমণ করে যেতেন। তিনি নিরস্ত্র লড়াইয়ের কলা কৌশল বা মার্শাল আর্ট এর উদ্ভব করেন প্রধানতঃ বন্যজন্তুর সাথে যুদ্ধ করতে। তখন এই স্থানে প্রচুর সংখ্যায় বাঘ চড়ে বেড়াত - এখন আমরা ওদের গুনতে পারি, আমাদের হাজারের থেকে অল্প কিছু বেশি সংখ্যক বাঘ রয়েছে , কিন্তু একটা সময় ছিল, যখন লক্ষ লক্ষ বাঘ, এবং আরও অন্যান্য বিপজ্জনক বন্যপ্রাণীরা সর্বত্র ঘুরে বেড়াত। অগস্ত্য মুনি “কালারি” - এর উৎপত্তি ঘটান এদের সাথে লড়াই করার উপায় হিসাবে, যেমন যদি বাঘ আসে, কীভাবে আপনি তার মোকাবিলা করবেন।
আপনি দেখবেন, “কালারি” এখনও তার আগের আদল বজায় রেখেছে। এটা শুধুমাত্র মানুষের সাথে যুদ্ধ করার কৌশল নয়। উনি কিছু স্বল্প সংখ্যক মানুষকেই “মার্শাল আর্ট” শিখিয়েছিলেন যাতে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের সময় তারা বন্য জন্তুদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, আর তা আজও টিকে আছে।
"কালারি" থেকে "কারাটে"
যখন এখানকার মানুষ হিমালয় পেরিয়ে গেলেন, তখন তারা কিছু বন্য-মানুষের সম্মুখীন হলেন, যারা ভ্রমণকারী দেখলেই তাদের আক্রমণ করতেন। তখন যে কৌশল তারা বন্য জন্তুর মোকাবিলায় শিখেছিল, তা ওই বন্য মানুষদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। যখন থেকে তারা একে মানুষের উপর প্রয়োগ করতে শুরু করলেন, তখন থেকেই এই মার্শাল আর্ট-এ লক্ষণীয়ভাবে রূপান্তর ঘটল। ভারত থেকে যত বেশি করে চীনের দিকে বা আরও এগিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দিকে যাবেন, ততই দেখবেন “ঝুকে দাঁড়িয়ে“ করা মার্শাল আর্ট থেকে “সোজা হয়ে দাড়ানো” মার্শাল আর্ট এর বেশি নিদর্শন পাওয়া যাবে।
যখন আপনি মানুষের সঙ্গে লড়াই করেন, তখন মেরে ফেলার জন্যই করেন। কিন্তু বন্য প্রাণীর সাথে ব্যাপারটা সেরকম নয়। যে মুহূর্তে আপনি এটা বুঝিয়ে দিতে পারবেন যে আপনি একটি খুবই দুঃসাধ্য রকমের "খাবার", বন্য প্রাণীরা চলে যাবে। সেই কারণেই মার্শাল আর্ট - এর পরিবর্তনটা হয়েছিল বন্যজন্তুদের তাড়িয়ে দেবার চমৎকার এক কলা কৌশল থেকে এক মেরে ফেলার বিদ্যায়। আপনি "কালারি" থেকে "কারাটে"-তে ঠিক এই রূপান্তরই দেখতে পাবেন।
পরবর্তীকালে, লোকে ভারতেও মানুষের সঙ্গে লড়তে কালারির ব্যবহার শুরু করেছিলেন, কিন্তু তারা এই কলাটিকে বিশেষ একটা রূপান্তরিত করেননি। পরিবর্তে, তারা অস্ত্রবিদ্যার সংযোজন করেছিলেন। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, “কালারি” হয়তো “কারাটের” মত অতটা দক্ষতাপূর্ণ নয়, কারণ, ‘কারাটে‘ যেহেতু দুই পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে করা হয়। “কালারি” তে আপনি নিচের দিকে ঝুঁকে কিছু দেখার চেষ্টা করছেন, কারণ আমরা এটাকে কোনও মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করার কলা হিসাবে কখনও দেখিনি, বরং ব্যবহার করে এসেছি কেবলমাত্র বন্য জন্তুর মোকাবিলাতেই।
ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রথম পঞ্চাশজন মানুষের মধ্যে অন্যতম, সদগুরু - একজন যোগী, অতীন্দ্রিয়বাদী , দূরদর্শী এবং “নিউ ইয়র্ক টাইমস”-এ প্রকাশিত সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক। ২০১৭ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্ম বিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন; এটি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক বাৎসরিক পুরস্কার, যা বিরল ও বিশিষ্ট সেবামূলক কাজের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়াও তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জন-অভিযানের প্রতিষ্ঠাতা, যা “কনশাস প্ল্যানেট “- ”সেভ সয়েল “ অভিযান (Conscious Planet - SaveSoil) নামে পরিচিত এবং এখনও পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩৯১ কোটি মানুষের কাছে এই অভিযান পৌঁছে গেছে।
বিঃদ্রঃ - প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়