সদগুরু: সম্প্রতি, আমি আমেরিকার রাজ্য বিভাগের একজন গণ্যমান্যের সঙ্গে কথা বলছিলাম। আমি তাঁকে  জিজ্ঞাসা করলাম, "পাকিস্তানের সাথে আপনাদের এত ভক্তি-ভালোবাসার কারণটা কী? দেশটা কী কী করে সেই সব জানা সত্ত্বেও, আপনারা তাদেরকে আরও আরও দিয়েই চলেছেন অথচ ঐতিহাসিকভাবে আমাদেরকে বেশ ভুগিয়ে গেছেন।“


তিনি বললেন, "সদগুরু, এই সমস্যাটা আজকের নেতৃত্বের নয়।  ১৯৪৭ সালে যখন আপনারা স্বাধীনতা পেলেন, তখন বিশ্বের দরবারে পৌঁছনোর জন্য আমাদের তেমন কোনও প্রকৃত নাগাল বা উপায় ছিল না।   আমাদের তথ্য (তথ্যের উৎস) আর বিশ্বের নাগাল পাওয়ার মাধ্যম  ছিল শুধুমাত্র ব্রিটিশরাই।  তাঁরা আমাদের সামনে এক স্পষ্ট ছবি তুলে ধরেছিলেন যে পাকিস্তান সফল হবে কারণ তার একটাই ধর্ম, একটাই লক্ষ্যকেন্দ্র।  ইন্ডিয়া (ভারত) নিজেই নিজেকে মেরে ফেলবে কারণ এর মধ্যে অনেককিছু একসঙ্গে রয়েছে।"


মানুষজন আমাদের জটিলতাকে ছোট করে দেখেছিলেন; ভারত এখন নিশ্চিতভাবেই অভ্যুত্থানের পথে রয়েছে। ভারতের সৌন্দর্য হল এটাই যে একইরকম কোনও কিছুর ভিত্তিতে বা কোনও মিল থাকার  দরুণ  এই দেশ তৈরি হয় নি।  যখন মানুষ দেশ গড়েন, তাঁরা সবসময় ভাষার মিল, ধর্মের - বর্ণের - জাতির মিল খোঁজেন।  তাঁরা সবসময় ভাবেন এই “একইরকম ব্যাপারটা বা মিল থাকাটাই” শক্তি দেয়, কিন্তু আমরা এই সব ধারণাকে হার মানিয়েছি।  আপনি যদি ৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে যান, দেখবেন মানুষজনকে  দেখতে আলাদা, তাঁদের কথা বলা, পোশাক-পরিচ্ছদ  আর খাবার-দাবার - সবই আলাদা। 


ভারতের ভাষা-সম্পদ 


ভাষা হল অন্যতম সবচেয়ে জটিল একটা কাজ যা আমরা আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে করে থাকি।  যে কোনও ভাষাকে একটা পরিপূর্ণ ভাষা হয়ে উঠতে গেলে সম্ভবত এক হাজার বছর বা তারও বেশি সময় লাগে।  এই দেশে আমাদের ১৩০০-এরও বেশি উপভাষা আর কথ্য ভাষা রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোনও সংস্কৃতি বা সভ্যতা এত সংখ্যক ভাষার জন্ম দেয় নি যেমন আমরা দিয়েছি।  এর মানে হল আমাদের মস্তিষ্ক এতটাই সক্রিয় রয়েছে এক লম্বা সময় ধরে।  কিন্তু এখন আমরা সেটাকে অব্যবহারে অকেজো করবার চেষ্টা করছি।  


নিজেদের ভাষা নিয়ে গর্ব বোধ করাটা খুব জরুরি, কিন্তু সেটা নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়া উচিত না।  কিন্তু আজকে, স্থানীয় ভাষার পরিস্থিতিটা গর্ব থেকে পক্ষপাতদুষ্টতার দিকে সরে আসছে। কন্নড় ভাষায় একটা কথা আছে যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "যখন দুজন যুদ্ধ করেন, তৃতীয়জন লাভবান হন।" আমাদের কাছে এই দেশে একেবারে জটিল আর অসাধারণ সব ভাষা রয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এই যে, আমরা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছি যেখানে একমাত্র সমাধান হল ইংরাজিতে কথা বলা।  একটা বিদেশী ভাষা লাভবান হচ্ছে কারণ আমরা নিজেদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া করে উঠতে পারছি না। 


আবার একই সঙ্গে, ইংরাজি ভাষা ছাড়া, আপনি পঙ্গু হয়ে যাবেন কারণ আজকে প্রায় সবকিছুই ইংরাজিতে হয়। তাই আমি রাজ্য সরকারদের কাছে এই পরামর্শ দিচ্ছি যে, সমস্ত শিশুদের দুটো ভাষা লিখতে ও পড়তে শেখা উচিত - একটা ভাষা অবশ্যই মাতৃভাষা হওয়া উচিত আর অন্যটা ইংরাজি, কারণ এটাই বিশ্বের দুয়ারে আপনার পাসপোর্ট। এবং এর সঙ্গে কথা বলার ভাষা হিসেবে দু'টো বা তিনটে ভাষার পরিচয় করানো যেতে পারে ।  


তামিলনাডু, কর্ণাটক আর অন্ধ্রপ্রদেশের এমন বহু মানুষ আছেন যাঁরা স্থানীয় ভাষায় পড়াশোনা করেছেন আর তাঁরা দেশের মধ্যেই অন্য একটা রাজ্যে যেতে রীতিমত ভয় পান কারণ তাঁরা সেখানকার স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন না বলে। কাজেই যদি আমরা সবাই অন্তত পাঁচটা ভাষায় কথা বলতে পারি সেটা ভারী চমৎকার হবে। এতে একজন মানুষ অনেক বেশি বহুমুখী হয়ে উঠবেন এবং বাইরে ভ্রমণ করার জন্য সুদক্ষ করে তুলবে। এতে করে আমরা একটা দেশ হিসেবেও অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবো এবং একইসঙ্গে, আমরা আমাদের সংস্কৃতির শিকড়টাও হারিয়ে ফেলবো না।  


ভারত হল একটা ক্যালাইডোস্কোপের মতো। এই ক্যালাইডোস্কোপকে কীভাবে সত্যিই চিত্তাকর্ষক এবং অপূর্ব করে তোলা যায়, এবং এর ভেতরে যাতে কোনও অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব-সংঘাত না ঘটে, তা দেখা আমাদের দায়িত্ব। এই দেশের প্রকৃতি সবসময়ই এরকম হয়ে এসেছে এবং আমাদের এটাকে ঠিক তেমনভাবেই রেখে দেওয়াটা আবশ্যক।   


বি : দ্র :  প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়