সদগুরু : কিছু সময় আগে, আমি মুম্বাইতে ছিলাম। একপাশে ছিল বড় বড় অভিনব সব দালান; অন্য পাশে ছিল বস্তি। তখন ছিল বর্ষা-পরবর্তী সময়। বর্ষার সময় নর্দমাগুলো সচরাচর উপচে পড়ে। প্রায় দেড়শো একর বা তারও বেশি জায়গা জুড়ে থাকা এই পুরো বস্তিটা প্রায় এক ফুট গভীর নোংরায় ভরে যায় এবং লোকজন এর মধ্যে দিয়েই চলাফেরা করেন এবং এর মধ্যেই থাকেন, যেন এটা কোনও সাধারণ একটা ব্যাপার। ঠিক এইরকম অবস্থাতেই পরিযায়ীরা বাস করছেন।


এখন যেমন, প্রায় ১১ থেকে ১২ কোটি মানুষ বস্তিতে বসবাস করছেন, যা ভারতের শহুরে জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে, ২২ কোটি মানুষ ভারতের গ্রামগুলো থেকে শহরে চলে আসবেন। এমনটা হলে, শহরগুলোর যে কী শোচনীয় অবস্থা হবে তা আপনারাই কল্পনা করুন। আমাদের প্রতিটা শহরে যদি ১ কোটি করে বাড়তি লোক আসেন তাহলে এই জায়গাগুলোতে কেউই ভালভাবে বসবাস করতে পারবেন না।
কিন্তু কী কারণে মানুষ তাদের শত শত বছরের যে বসতভূমিতে পরিবার নিয়ে থেকেছেন, তা ছেড়ে যাচ্ছেন? মানুষ পালিয়ে যেতে চাইছেন কারণ সেখানে কোনও জীবিকা নেই। যদি তারা তাদের গ্রামে একটা শালীন জীবনযাপন করতে পারতেন তাহলে বেশিরভাগই এত তাড়াহুড়ো করে দেশান্তরিত হতেন না। তারা পরিবারের একজন সদস্যকে শহরে পাঠাতেন কী ঘটছে দেখতে, উপার্জনের উপায় করতেন, বাড়ি তৈরি করতেন এবং তারপরে যেতেন। কিন্তু এখন, কোনওরকম পরিকল্পনা ছাড়াই প্রত্যেকেই স্থানান্তরিত হচ্ছেন কারণ তারাও একপ্রকার বাধ্য।


যদি আমরা এই অভিবাসনকে আটকাতে চাই, তাহলে আমাদের গ্রামীণ ভারতের নগরায়ন করতেই হবে। সবচেয়ে সহজ কাজ যেটা আমরা করতে পারি তা হল সরকারি স্কুলগুলোকে উন্নত করা। বিল্ডিং আছে,  পরিকাঠামো আছে, কিন্তু শিক্ষার যে পরিকাঠামো ও শিক্ষার যে সংস্কৃতি দরকার, অধিকাংশ জায়গাতেই তা নেই। এই মুহূর্তে দেশে অন্তত আশি লক্ষ থেকে এক কোটি ১৫-১৬ বছর বয়সীরা আছেন যারা মনে করেন তারা শিক্ষিত কিন্তু তারা দুই যোগ দুই করতে পারেন না। যদি আমরা এই স্কুলগুলোকে কোনও বিশেষ শর্তে না বেঁধে বেসরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করি, তাহলে এমন অনেক শিল্প এবং ব্যবসা রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব অর্থ দিয়ে সরকারি তহবিলের পরিপূরক করে একশোটা স্কুল ভালভাবে চালাতে পারে।
এই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটা দুর্বলতা হল যে শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে কৃষিকাজ বা কাঠের কাজের মতো কোনও দক্ষতাও শেখে না। তাদের কোনও পড়াশুনা বা দক্ষতা নেই আর তারা উচ্চশিক্ষার জন্যও ভাবছে না। এটা একটা বিপজ্জনক অবস্থা কারণ, যে যুবকদের কর্মসংস্থানের কোনও  সম্ভাবনা নেই তারাই দেশে অপরাধমূলক, জঙ্গি এবং অন্যান্য ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রধান প্রার্থী। সুতরাং, তাদেরকে কিছুতে দক্ষ করে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা গ্রামে না হলেও অন্তত প্রতিটা তালুকে দক্ষতা কেন্দ্র (স্কিল সেন্টার) থাকা আবশ্যক। বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার কারণ সবকিছুর জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হলে অনেক সময় লেগে যাবে।


এরপরে যা করা দরকার তা হল, প্রতিটা গ্রামে একটা সিনেমা থিয়েটার চালু করা, কারণ লোকেরা কেবল একটা সিনেমা দেখার জন্য শহরে আসছেন। আর একবার এলে তারা আর বাড়ি ফিরে যান না। কিছু খেলাধুলার সুবিধাও গড়ে তুলতে হবে। যদি বিশাল স্টেডিয়াম না-ও হয়, তরুণদের জন্য অন্তত কিছু জিমনেসিয়াম তৈরি করতে হবে কারণ দেশে আরও ১০-১৫ বছরের মধ্যে অ্যালকোহল এবং মাদক সেবনের ব্যাপক বৃদ্ধি একটা গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠবে। বহুকাল আগে যখন আমি বেশ কয়েকজন বস্তিবাসীদের সঙ্গে কাজ করতাম, তাদের প্রায় আশি শতাংশই সন্ধ্যায় মদ্যপান করতেন। যখন আমি একটা জিমনেসিয়াম শুরু করেছিলাম এবং সমস্ত যুবকদের সেখানে নিয়ে এলাম, তাদের মধ্যে সত্তর শতাংশেরও বেশি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ তারা সবাই তাদের ফিটনেস-স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।


বিনোদন, খেলাধুলা, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন (skill development) – এই সকল সম্ভাবনাকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালের মধ্যে থাকতে হবে। আমরা যদি এটা করি, তাহলে আমরা অবশ্যই গ্রাম থেকে অভিবাসনকে আটকাতে পারব। আমরা এটাকে জোর-জবরদস্তি করে আটকাতে পারব না। আমরা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরি করে এবং শহর ও গ্রামকে বসবাসের জন্য আরও আকর্ষণীয় করে তোলার মাধ্যমেই এটাকে সম্ভব করতে পারি।


সদগুরু একজন যোগী, অতীন্দ্রিয়বাদী, দূরদর্শী এবং নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলিং লেখক। তিনি ভারতের পঞ্চাশজন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান পেয়েছেন।  ব্যতিক্রমী এবং বিশিষ্ট সেবার জন্য, সদগুরুকে ২০১৭ সালে ভারত সরকার, ভারতের সর্বোচ্চ বার্ষিক বেসামরিক পুরস্কার “পদ্মবিভূষণ” পুরস্কারে ভূষিত করেছে। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম জন-অভিযান, “কনসাস প্ল্যানেট – সেভ সয়েল”  (সচেতন পৃথিবী – মাটিকে বাঁচান) -এর পথপ্রদর্শক, যা ৩৯০ কোটিরও বেশি মানুষকে স্পর্শ করেছে।


বি : দ্র :  প্রতিবেদনটি এবিপি লাইভ কর্তৃক সম্পাদিত নয়