নয়াদিল্লি, বিনয় লাল: ১৮ নভেম্বর থেকে কাতারে শুরু হয়েছে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের (FIFA WC 2022) মহারণ। বিশ্বকাপের উন্মাদনার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে, এমন কিছু খুঁজে পাওয়া সত্যিই বেশ কঠিন। কয়েকদিন আগেই আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছিল। নেদারল্যান্ডস বাদে বাকি সব দেশগুলিতেই মোটামুটি ইংল্যান্ডের সৌজন্যেই ক্রিকেটের প্রাধান্য। আমেরিকা তাদের বেসবলের ফাইনালকে 'ওয়ার্ল্ড সিরিজ' নাম দিয়েছে। তেমনভাবেই মূলত আমেরিকার (কয়েকটি কানাডার) দলগুলিকে নিয়ে খেলা বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট, যেখানে কয়েক দশক আগেও আমেরিকার খেলোয়াড়দের বাদে অন্য দেশের খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়াটাও কঠিন ছিল, তাঁর বিজেতা 'বিশ্বচ্যাম্পয়ন' অ্যাখ্যা দেয়। তবে এই খেলাগুলি নিঃসন্দেহে একটি অঞ্চলের মধ্যেই কিন্তু সীমাবদ্ধ। প্রকৃত অর্থে যে খেলাটি বিশ্বজুড়ে খেলা হয় এবং যার বিশ্বকাপের তকমা পাওয়া একেবারেই যুক্তিযুক্ত, তা হল ফুটবল।
'আসল' বিশ্বকাপ
৩২টি দল একাধিক যোগ্যতা অর্জন পর্ব পার করে এবারের বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার ছাড়পত্র জোগাড় করেছে। চার বছর পরের বিশ্বকাপে সেই সংখ্যাটা বেড়ে ৪৮ হবে। বিশ্বকাপ মানেই সমর্থকদের উন্মাদনা, বাহারি পোশাক, হরেক রকমের পণ্যদ্রব্য। বিশ্বকাপে দল গোল করে সমর্থকদের মধ্যে যে আবেগের সঞ্চার ঘটে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যে কোনও খেলাতেই তা খেলোয়াড় হোক বা সমর্থক, সকলের মধ্যেই প্রবল জাতীয়তাবোধ কাজ করে। তবে এই খেলার মাধ্যমেই মুহূর্তের মধ্যেই যেমন কেউ জাতীয় নায়ক হয়ে যান, তেমনই জাতীয় খলনায়ক হতেও খুব বেশি সময় লাগে না।
বিশ্বকাপই এমন এক মঞ্চ, এমন এক টুর্নামেন্ট যার জন্য মানুষজন বছরের পর বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখেতে সাত সমুদ্র পার করা থেকে নিজের জীবনের সমস্ত জমানো টাকাও খরচ করতে দ্বিধা বোধ করেননা ফুটবলপ্রেমীরা। এই ভালবাসা, এই উন্মাদনার কোনওরকম কোনও বিকল্প হয় না। তবে অনেকেই দাবি করে থাকেন অলিম্পিক্স এই উন্মাদনা, উত্তেজনার নিরিখে কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপকে চ্যালেঞ্জ জানানোর যোগ্য দাবিদার। তবে অলিম্পিক্স অনেক ধীর,স্থির। অলিম্পিক্সের লড়াইয়ে ফুটবলের মতো প্রতি মুহূর্তে উত্তেজনা নেই। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কোনও এক উসেইন বোল্ট ট্র্যাকে আগুন ঝরিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি করেন বটে। বা জিমনাস্ট, ডাইভার্সরা জলে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তাদের তালমেলে দেশের নাম উজ্জ্বল করেন বটে। তবে বিশ্বকাপের সেই উত্তেজনা তার মধ্যে নেই। সেই কারণেই হয়তো বিগত দুই দশকে অলিম্পিক্সের মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চিনের জায়গা তৈরি করে নেওয়াটা খুব একটা বিস্ময়কর বলে মনে হয়নি বা বিশ্বকাপ ফুটবলের ধারেকাছেও তাঁদের না থাকায় কেউ অবাক নন। তবে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিও বিশ্বকাপের উন্মাদনা ও বিশলতার সমুদ্রে হারিয়ে যেতে পারে।
এবারের ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের অন্ত নেই। শুরু হয়ে সপ্তাহখানেক পার না হলেও, ইতিমধ্যেই সৌদি আরবের বিরুদ্ধে আর্জেন্তিনার পরাজয়ের মতো তথাকথিত দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে যে কাতারিরা নাকি টাকার বিনিময়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছেন। ইউরোপিয়ান কাছে এই বিষয়টি একেবারেই হজম হচ্ছে না। বর্ণবৈষম্য, জোর করে উপনিবেশ গড়ে ধীরে ধীরে একাধিক দেশের দায়িত্ব নিজের হাতে ছিনিয়ে নেওয়া, এসব শিক্ষা ইউরোপিয়ানরাই বাকি বিশ্বকে দিলেও, তাঁরাই এখন কাতারিদের দোষ, গুণ বিচার করার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
সাধারণত গ্রীষ্মকালে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়। তবে কাতার গরমের দেশ। সেই কারণেই অন্যান্য বারের থেকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় বদল করে তুলনামূলক ঠান্ডা মরসুমে তা আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হয়তো এই সময় বদলটাই ইউরোপিয়ানরা মেনে নিতে পারছে না। তবে বিশ্বকাপে সবথেকে বেশি ইউরোপিয়ান দলগুলিই অংশগ্রহণ করলেও, তাঁদের এটা বোঝা দরকার যে গোটাবিশ্ব আর ইউরোপকে কেন্দ্র করে ঘোরে না।
কাতারে সমকামী সম্প্রদায়ের সমর্থনে সমর্থকদের নির্দিষ্ট রঙের আর্মব্যান্ড পরায় নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে বলে চারিদিকে শোরগোল। মাঠে মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায়ও কম সমালোচনা হয়নি। তবে এর থেকে বিশ্বকাপের স্টেডিয়ামগুলি তৈরি করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়া শ্রমিকদের হয়ে আওয়াজ তোলাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেই নিয়ে অবশ্যই আরেকদিন লেখা যাবে। তবে সেই মৃত্যুমিছিল কেবলই এক ফুটনোটের মতো রয়ে গিয়েছে। একদিকে নিজেদের পেটের দায়ে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে এই শ্রমিকরা নিজেদের জীবন হারাচ্ছেন, অপরদিকে ফিফার আয় পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বিশ্ববন্দিত ফুটবলাররাও প্রতি বছর গুচ্ছ গুচ্ছ অর্থ উপার্জন করেন।
তবে এই বিতর্ক, বিবাদ একপাশে সরিয়ে রাখলে বলতেই হয় যে এই বিশ্বকাপে কিন্তু ইতিমধ্যেই তাক লাগিয়ে দেওয়া একাধিক প্রতিভা মাঠে নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। স্পেন কোস্তা রিকাকে ৭-০ গোলে পরাজিত করে। অনেকসময় তো এটি বিশ্বকাপের ম্যাচের বদলে স্পেনের অনুশীলন বলেই মনে হচ্ছিল। নারীদের নৈতিক অধিকারের দাবিতে উত্তাল ইরান। তাঁরা ইংল্যান্ডের হাতে ৬-২ গোলে কার্যত পর্যুদস্ত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৪-১ ব্যবধানে জিতে ফ্রান্সও বিশ্বকাপের শুরুটা দারুণভাবে করেছে। তবে এই বিশ্বকাপে একদিকে যেমন চিরাচরিত বড় দলগুলি প্রত্যাশিতভাবে বড় জয়ে পেয়েছে, তেমন বেশ কিছু বড় দলকে মুখ থুবড়েও পড়তে হয়েছে। জার্মানির মতো শক্তিধর দেশকে জাপান হারিয়ে দেবে, এমন স্বপ্ন কতজনই বা দেখেছিলেন! তবে ফুটবল মাঠে জাপানের দুই স্ট্রাইকারের দুই গোল জার্মানিকে হারানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
অঘটনের বিশ্বকাপ
তাইয়ো নামের এক নদী ওটার নাকি আগেই জাপানের বিশ্বজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। ওটারটি একটি ছোট ফুটবল জার্মানির পতাকা আঁকা ছোট এক বালতি উপেক্ষা করে জাপানের লাল বালতি, ড্রয়ের হলুদ বালতি উপেক্ষা করে নীল রঙের জাপানের বালতিতে ফেলেন। কয়েক দশক আগেও ইউরোপিয়ান হয়তো এইসব বিষয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে স্রেফ অন্ধবিশ্বাস বলে হেসে উড়িয়ে দিত। তবে বিশ্ব এখন জার্মানিকে দেখে হাসছে। জার্মানরা অপরদিকে এই জয়ের উচ্ছ্বাস পালনে অনেকটা সৌদি আরবের মতোই জাতীয় ছুটি ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন। এই থেকেই তাহলে এবার বিশ্বকাপের বা বিশ্ব ক্রীড়াক্ষেত্রের সবথেকে বড় বিস্ময়ের দিকে নজর দেওয়া যাক।
সৌদিদের দেশ থেকে এই বিশ্বকাপে অন্তত কারুরই কোনও প্রত্যাশা নেই। সৌদিকে দেশটি সম্পত্তি বৃদ্ধি করার জন্য কোনওরকম উপায় বাকি রাখেনি। গোটা বিশ্বকে তাদের দেশে প্রাপ্ত তেলের ওপর নির্ভরশীল করাতে আগ্রহী সৌদি। খেলাঘুলার ময়দান নয়, বরং স্বৈরাচারী শাসক থেকে মহিলাদের গাড়ি চালাতে বাঁধা (কয়েক মাস আগে পর্যন্ত) দেওয়ার মতো নেতিবাচক কাণ্ডের জন্যই সৌদি বেশি বিখ্যাত। সৌদির ফুটবল দলও আন্তর্জাতিক স্তরে একেবারে তেমন অভিজ্ঞ নয় এবং বেশিরভাগ ফুটবলারেরই দেশের বাইরে খেলার কোনও অভিজ্ঞতাও নেই। অপরদিকে তাঁদের প্রতিপক্ষ আর্জেন্তিনা গত বছরই ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আর্জেন্তিনার জনগণের শয়নে, স্বপনে শুধুই ফুটবল।
এই অসম ম্যাচের আগে সৌদি আরবের নেতা মহম্মদ বিন সলমন দলের ফুটবলারদের জয়ের কথা চিন্তা না করে কেবলই এই ম্যাচটা উপভোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সৌদি ফুটবলাররা তাঁদের শাসকের নির্দেশ অবজ্ঞা করে ম্যাচ উপভোগ করার পাশাপাশি ম্যাচ জেতেও। এক চোখ ধাঁধানো গোলের সুবাদে আর্জেন্তিনাকে হারানোয় সৌদির জয়ের মাহাত্ম্যটা যেন কিছুটা হলেও বেড়ে গিয়েছে। গোলদাতা আল দওসারির অনবদ্য দক্ষতারই পরিচয়বাহক এই গোলটি। এই জয়ের আনন্দ উপভোগ করতে সলমন পরের দিন জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেন।
বিশ্বকাপে সৌদি কতদূর এগোতে পারে, তা বলা মুশকিল। এক দশক আগের বসন্তে মরুদেশের রাজনীতি বিশ্বমঞ্চে ঝড় তুলেছিল বটে। তবে তা একেবারেই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অনেকে তো মনে করেন এর ফলেই সেই দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, যার দরুণ আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসির, (মিশরের রাষ্ট্রপতির) মতো স্বৈরাচারী নেতাদের আর্বিভাব ঘটে। সৌদি আরবের জয়টাকে সকলে বিস্ময় জয় হিসাবেই গণ্য করছেন। কেউ কেউ মনে করছেন এই জয় আরব দেশে ফুটবলের উন্নতির পথপ্রদর্শকও হবে, যার ফলে বিশ্বকাপে ইউরোপ, লাতিন আমেরিকান দেশগুলির আধিপত্য অবেশেষে খর্ব হবে। আফ্রিকা, এশিয়া তথ্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির ফুটবলবিশ্ব শাসন করার স্বপ্নটা মন্দ নয়।
তবে এই জয় বা সলমনের উদারতারও ভালমন্দ, উভয় দিকই রয়েছে বটে। আমেরিকা, ইউরোপের বহু দেশ মনে করে সলমনের আদেশেই বছর চারেক আগে সাংবাদিক জামাল খাশোগ্গিকে ইস্তানবুলে হত্যা করা হয়। তারপর থেকেই সলমন নিজের ভাবমূর্তি বদলের প্রচেষ্টায় রয়েছেন। দলের এত বড় একটি জয়ের সুযোগে সব স্বৈরাচারী নেতাই নিজেদের উদারতা দেখানোর সুযোগ লুফে নেবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। ফুটবল বিশ্বকাপ কিন্তু কোনওদিনই শুধু ফুটবলে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজনীতি, ক্ষমতা, জাতীয়তাবোধ, সব কিছুই পরোক্ষভাবে হলেও এর সঙ্গে জড়িত। আস দওসারির গোল নিয়ে কোনওরকম প্রশ্ন থাকতে পারে না। দিনের শেষে এগুলিই তো ফুটবল বিশ্বকাপকে আর পাঁচটা টুর্নামেন্ট থেকে আলাদা করে।
লেখক ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলসে (UCLA) ইতিহাসের অধ্যাপক