বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন এক সামরিক অভ্যুত্থানে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে। ঊনপঞ্চাশ সাল বাদ সেই অভিশপ্ত অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখে গণ অভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিবকে যে হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে তার গোপন তথ্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল। ভারতের পক্ষ থেকে আগাম সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল, মুজিব গুরুত্ব দেননি।বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যপারে ভারত নাকও গলায়নি। হাসিনার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের খবর ভারতের কাছে ছিল কি না স্পষ্ট নয়। তবে যে দ্রুত তৎপরতার সঙ্গে হাসিনাকে ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিল, তাতে আগাম প্রস্তুতির ভাবনা অস্বাভাবিক নয় ।
ভারত উপদেষ্টা সরকারকে অভিবাদন জানিয়েছে, একেবারে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে। সেইসঙ্গে সংখ্যালঘু জীবন সম্পত্তি রক্ষার গুরুদায়িত্ব স্মরণ করিয়েছে। বাংলাদেশ অভিবাদন নিয়েছে, কিন্তু উপদেশ পালন করেনি। আক্রান্ত হিন্দু জীবন, মন্দির, সম্পত্তি। লুন্ঠিত হিন্দু-ইজ্জত। হিন্দুরা এই প্রথম পথে নেমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, তাতে আশার আলো জাগলেও বিপদ বেড়েছে স্থানীয় হিন্দুদের। সরকার-মৌলবাদীর যৌথ আক্রমণ তীব্রতর হয়েছে, হিন্দু হিসেবে বেঁচে থাকা এখন দুষ্কর। সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষা আন্দোলনের প্রধান পুরোহিত চিন্ময়কৃষ্ণ প্রভু, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার । আইনজীবী খুনের অভিযোগ যে কোনও সময় লাগতে পারে, তাঁর বিরুদ্ধে । তাঁর জামিনের আবেদনে প্রথম দিন একান্ন জন দাঁড়ালেও ,পরের দিন কাউকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি । হিপোক্রেটিক শপথের মতন ন্যায় ও পক্ষপাতহীন কাজ করার শপথ নিতে হয় যে আইনজীবীদের, তারাই বাধা দেয় চিন্ময়কৃষ্ণের পক্ষে কোন উকিল দাঁড়াতে। চিন্ময় প্রভুর আশু জেল মুক্তি অসম্ভব। সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার আন্দোলন স্তব্ধ। মুক্তমনারাও নেই শাহবাগ বা দেশের কোথাও কোনও আন্দোলনে । হিন্দু নিধন চলছে অবিরত । অন্য সময় হিন্দুরা দেশ ছেড়েছে , আশ্রয় নিয়েছে ভারতে ।এবার সে উপায় নেই। ভারতের সীমান্ত রুদ্ধ। নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯ বা সিএএ আইনে ২০১৪ ডিসেম্বরের পর থেকে ভারতে আসা হিন্দুদের নাগরিক হবার অধিকার নেই। তারা কি উদ্বাস্তু হিসেবেও আসতে পারবে না ? ভারত এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে এসেছিল উদ্বাস্তু হয়ে , কেউ কেউ থেকে গেলেও , অনেকেই ফেরত গেছেন মুক্ত বাংলাদেশে উন্নত জীবনের আশায় । এখন দরজা খুললে যারা আসবেন তাদের ফেরত যাবার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া বহু আতঙ্কবাদী হিন্দু সেজে ঢুকে পড়তে পারেন। তাই সব কিছু ভেবেচিন্তে সব সুরক্ষা নিয়েই এগোতে হবে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের (UNHCR) তত্বাবধানেই করলে, বিপদ কিছুটা কম ।
ভারত ভাবছে, বাংলাদেশে উত্তেজনা শীঘ্রই মিটবে । বাংলাদেশ ভারতের স্বাভাবিক মিত্র , চীন পাকিস্তানের উস্কানিতে ভারত এবং হিন্দু বিরোধিতায় মাতলেও , ভারতের কাছে ফিরতে বাধ্য । মালদ্বীপীয় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ মোইজ্জু চিনের বন্ধুত্বের সোনালি ফসলের আশায় অন্ধ ভারত বিরোধিতায় নেমেছিলেন, স্বপ্ন ভেঙেছে । ভারতের বন্ধুত্ব ফিরে পেতে বড়ই আগ্রহী । ভারত ভাবছে , শত উস্কানির পর বাংলাদেশ একই পথে চলবে । ভারত এতটা আত্মবিশ্বাসী যে এখনও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনারও কোনো প্রস্তাব রাখেনি। দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনায় বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান চাইছে । হাজারও উস্কানির পরও ভারত পাঠিয়েছে গুটি কয়েক স্টেটমেন্ট বা উত্তাপহীন বার্তা । বাংলাদেশ ডেকে পাঠিয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তাদের পররাষ্ট্র দপ্তরে । বৈঠকের পর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেন," আমাদের মধ্যে এত বিস্তৃত বহুমুখী সম্পর্ক, তা একটি ইস্যু বা একটি এজেন্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না”। ভারত প্রত্যুত্তরে, যা সব দেশ করে ,বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূতকে ডেকেও পাঠায়ওনি। একই সমস্যায় , কানাডার রাষ্ট্রদূতকেও ডাকা হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত নরমই থাকতে চায় ।
বাংলাদেশের ঘটনার প্রভাব স্থানীয় বাঙালি হিন্দু অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ , অসম আর ত্রিপুরার রাজনীতিতে বিরাটভাবে প্রবল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিবাহিনীর কথা বলে ইস্যুর মধ্যে থাকার চেষ্টা করেছেন। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা ইউনিট পথে নেমেছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি পথে নেই ।
লেখক - রাজাগোপাল ধর চক্রবর্ত্তী একজন অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। মতামত লেখকের নিজস্ব