অরিত্রিক ভট্টাচার্য ও প্রকাশ সিন্হা, কলকাতা : কখনও ঘেরাও, কখনও ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি। বারবার এই ট্রেন্ডের সাক্ষী থেকেছে বঙ্গ রাজনীতি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhadeb Bhattacharjee) মুখ্য়মন্ত্রী থাকাকালীন, তাঁর বাড়ির অদূরে অবস্থানে বসেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় (Mamata Banerjee)। তবে, মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় মুখ্য়মন্ত্রী হওয়ার পর, তাঁর বাড়ির দিকে এগোতে গিয়ে বারবার বাধা পেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। হাইকোর্ট অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কর্মসূচি বাতিল করার পর, চর্চায় উঠে আসছে সেসব ঘটনা।
কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগে বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। একাধিক কড়া প্রশ্ন তুলে, সোমবার যা বাতিল করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। তবে এই প্রেক্ষাপটেই, ফের একবার চর্চায় উঠে এসেছে ঘেরাও রাজনীতির বিষয়টি ! আর অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে আজ থেকে ১৪ বছর আগের কথা। যখন তৎকালীন মুখ্য়মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বাড়ির অদূরে অবস্থানে বসেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। টু স্ট্রোক অটোচালকদের পুলিশি ধরপাকড় এবং ধৃতদের মুক্তির দাবিতে, তৎকালীন মুখ্য়মন্ত্রীর বাড়ির অদূরে, মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের নেতৃত্বে তৃণমূলের সেই ধর্না চলেছিল রাতভর।
এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্য়মন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। তবে যখনই কোনও ইস্য়ুতে প্রতিবাদীরা তাঁর বাড়ির দিকে এগোনোর চেষ্টা করেছেন, তখনই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছে মাঝপথে।
২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুমোদনহীন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষামিত্রদের একাংশ আদিগঙ্গা পেরিয়ে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের বাড়ির দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন নিজেদের দাবিদাওয়া তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে। পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের জল থেকে তুলে নেন। ডিএ আন্দোলনকারীরা যখন মুখ্য়মন্ত্রীর বাড়ির এলাকা এবং অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের বাড়ির পাশ দিয়ে মিছিল করতে চেয়েছিলেন, তাতেও আপত্তি জানিয়েছিল পুলিশ। শেষমেশ কলকাতা হাইকোর্টে গিয়ে সেই অনুমতি আদায় করতে হয় তাঁদের। কিন্তু, সম্প্রতি ২১ জুলাইয়ের সভা থেকে সেই অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ই বিজেপি নেতাদের বাড়ি ঘেরাওয়ের ডাক দেন। আবার বিজেপির অনেক নেতার মুখেও শোনা যায় কালীঘাট অভিযানের হুঁশিয়ারি।
২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে অভিষেক বলেছিলেন, 'বিজেপির ছোট-বড়-মাঝারি-সেজো-মেজো, বুথ থেকে শুরু করে, অঞ্চল থেকে শুরু করে ব্লক থেকে বিধানসভা থেকে জেলা থেকে শুরু করে রাজ্য। যে ক'টা নেতা আছে আপনার ব্লকে, আগামী ৫ অগাস্ট শনিবার শান্তুপূর্ণভাবে এদের বাড়ি ঘেরাও করুন।'
অন্যদিকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, 'জনগণের অভ্যত্থান। চলো কালীঘাট। ইঁটগুলো খুলি।'
শেষমেশ অবশ্য় অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের ডাকা ঘেরাও কর্মসূচি বাতিল করল কলকাতা হাইকোর্ট।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক শুভময় মৈত্র বলছেন, 'আমরা বর্তমানে যেটা বুঝেছি, তৃণমূলের যাঁরা সমর্থক বা সদস্য তাঁরা বিজেপির যাঁরা সমর্থক বা সদস্য বা তাঁদের নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করবেন। দু'টো রাজনৈতিক মত একই বাড়িতে থাকেন, নির্বাচনে লড়াই করছেন...এরকমও আছে। সেই জায়গায় এই জিনিসটা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর সঙ্গে একেবারেই মেলে না। এই ধরনের একটা ভাবনা, তার বিরুদ্ধে কোর্টে গিয়ে রায় নিতে হচ্ছে, এটা আরও অবাক করার বিষয় ! কারণ, এটা তো কোর্টে যাওয়ার মত বিষয়ই নয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই, আন্দোলন এভাবে হতেই পারে না।'
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাদ মামুদ বলেন, 'যে ডাকটা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছিলেন, 'এটা বলা হচ্ছিল যে প্রত্যেকটা তৃণমূলের লোক প্রত্যেকটা বিজেপি লোকের বাড়ি ঘেরাও করে ফেল। এটা হচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং সামাজিক অরাজকতা তৈরি করার জন্য যথেষ্ট। যে কোনও সুস্থ গণতন্ত্রে ঘেরাও হওয়া উচিত নয়। যদি গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার থাকে, ভোটে লড়ার অধিকার আছে, রাজনীতি করার অধিকার আছে। মানুষের হাঁটাচলা করার অধিকার আছে। ঘেরাও হচ্ছে, সেটাকে আঘাত করা। অনেকদিন ধরে কোনও একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পর ঘেরাও হল, তাও সেটা হবে প্রতীকী। ঘেরাও করে বন্ধ করে রেখে দিলাম, এটা কোনও দিন সুস্থ গণতন্ত্রে হতে পারে না।'
হাইকোর্টের এই কড়া মন্তব্য় কি ঘেরাও রাজনীতির প্রবণতায় রাশ টানতে পারবে? সেটাই দেখার।