দীপক ঘোষ, আশাবুল হোসেন ও ঝিলম করঞ্জাই, কলকাতা : শুক্রবার ইডি-র (Enforcement Directorate) তদন্তকারী অফিসারকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অমৃতা সিন্হা (Amrita Sinha)। এর আগে সোমবার, নিয়োগ দুর্নীতির মামলাতেই (Recruitment Scam Case) ইডি-র তদন্ত নিয়ে একের পর এক কড়া প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি সিন্হা। এমনকী, ইডি-র তদন্তকারীরা এধরনের তদন্তের জন্য় প্রশিক্ষিত কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি।


সপ্তাহের প্রথম দিনই, নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় ইডি-কে কড়া ভর্ৎসনা করেছিলেন। আর সপ্তাহের শেষ কাজের দিনে ইডি-র তদন্তকারী অফিসার মিথিলেশ মিশ্রকে সরিয়েই দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিন্হা।

নিয়োগ দুর্নীতিতে ইডি-র তদন্তে তিনি যে প্রবল অসন্তুষ্ট, তা সোমবারের শুনানির ছত্রে ছত্রেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিচারপতি। এমনকী ইডি-র উদ্দেশে তিনি এই প্রশ্নও করেছিলেন যে, এ ধরনের তদন্তের জন্য় আপনারা কি আদৌ প্রশিক্ষিত ? চাপ বেশি হয়ে যাচ্ছে ? নিষ্কৃতি চান ? আপনারাই তথ্য় ধামাচাপা দিচ্ছেন ? সন্দেহ হলে আপনাদের কাজ তদন্ত করা। তদন্ত কি আদৌ করছেন ? আদালত কবে প্রশ্ন করবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছেন কেন ? এই গতিতে তদন্ত চললে কতদিনে সুড়ঙ্গের শেষে পৌঁছোবেন ?


এ প্রসঙ্গে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "ইডি-সিবিআই খুবই হাল্কাভাবে চলছে। সবাই দেখেছে, বিশেষ করে কোর্টের কাছে ধমক খেতে হয়েছে। যেখানে সবাই যেটা জানেন যে সম্পদ, যে সম্পত্তি সেটাও নাকি তদন্তে খুঁজে পাওয়া গেল না। তদন্তে তো কার্পেটের তলায় যেটা আছে, সেটা টেনে বের করতে হবে। আর যেটা প্রকাশ্য, হলফনামায় আছে, সেটাও ED, CBI বলতে পারছে না। তার মানেটা কী ? তার মানে, তদন্ত প্রক্রিয়া কার্যত ED, CBI ধামাচাপা দিতে চায়। কেন করতে হচ্ছে ? কোর্টের চাপ। "

সেদিন তাদের রিপোর্টের ফাঁকফোকড় ধরে ধরেই, ইডি-কে একের পর এক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিলেন বিচারপতি অমৃতা সিন্হা। ইডি-র উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, কিছু নথি বাজেয়াপ্ত করা ছাড়া আপনারা কোম্পানির (লিপস অ্য়ান্ড বাউন্ডস) সম্পত্তির বিষয়টি দেখেননি ? সম্পত্তির তালিকা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ? সম্পত্তির তালিকা চাওয়ার জন্য় আদালতকে নির্দেশ দিতে হল কেন ? সংশ্লিষ্ট ব্য়ক্তিদের তথ্য় দিতে বলাটা আপনাদের কাজ ছিল না ? কী চান? তদন্ত চলুক, নাকি দেরি হোক, যাতে তথ্য়-প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায় ?

লিপস অ্য়ান্ড বাউন্ডস কোম্পানি প্রসঙ্গেও ইডি-র উদ্দেশে বিচারপতি অমৃতা সিন্হা প্রশ্ন করেছিলেন, মেমোরেন্ডাম অফ অ্য়াসোসিয়েশন পরীক্ষা করেছেন ? এই কোম্পানির কাজ কী ? নথি তো বলছে, এই কোম্পানি জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ অবধি সব করে ! কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের সময় ২ জন ডিরেক্টর ছিলেন, রিপোর্টে দেখছি ৩ জন ডিরেক্টর। তৃতীয়জন কবে কীভাবে এলেন ? আইনে আপনাদের তল্লাশি চালানো, বাজেয়াপ্ত করা, অ্য়াকাউন্ট ফ্রিজ করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। কোম্পানি (লিপস অ্য়ান্ড বাউন্ডস) সন্দেহজনক লেনদেন করছে জানার পর, এর কোনওটা করার কথা ভেবেছেন ?


অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের সম্পত্তির তালিকা প্রসঙ্গেও ইডি-র উদ্দেশেও বিচারপতি অমৃতা সিন্হা প্রশ্ন করেন, তিনি সংসদের সদস্য়, ব্য়াঙ্ক অ্য়াকাউন্ট নেই? থাকলে তালিকায় তার প্রতিফলন নেই কেন ? কীরকম রিপোর্ট তৈরি করেছেন ? আপনার দফতর কি পোস্ট অফিস ? কেউ একজন পাঠিয়ে দিল, আর আপনি প্রিন্ট আউট করে দিলেন ? আপনারাই কি তথ্য় লুকোচ্ছেন ?


এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা নেপাল মাহাতো বলেন, "এই বিষয়গুলো আদালত পর্যন্ত যাবে কেন ? আদালতে একবার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে, ইডি-সিবিআই করুক ব্যস ! সেই সংস্থাগুলোর কাজ হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজগুলো ত্বরাণ্বিত করে শেষ করে দেওয়া। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন প্রতিটি পদক্ষেপে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।"


এনিয়ে রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "এত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনি ব্যবস্থাও দীর্ঘসূত্রিতা, এত কিছু পরেও কিন্তু মানুষের আদালতের উপরে আস্থা আছে। মানুষ সেটা বিশ্বাস করছে যে, আদালতই শেষ কথা। আদালত আছে বলেই এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত সম্ভব হচ্ছে। আদালত নিশ্চয়ই একটা সুরাহা করবে এবং প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করবে।"


তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন বলেন, "কিছু কিছু বিচারপতি যাঁরা বিচারব্যবস্থার ধারক ও বাহক , যাঁরা ভারতের গণতন্ত্রের একটা অন্যতম স্তম্ভের ধারক ও বাহক, তাঁরা সংকীর্ণ রাজনীতিমনস্ক আচরণ করছেন। তাঁরা কিছু রাজনৈতিক নেতার মতো আচরণ করছেন। যেটা দেখে আমাদের মনে হচ্ছে, বিচারব্যবস্থা আদৌ এই ভারতে এবং বিচারব্যবস্থা আদৌ এই রাজ্যে এই সমস্ত ধারক-বাহকদের হাতে নিরপেক্ষ আছে তো ? "

বিচারপতির এই প্রশ্নবাণের পর অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়কে মঙ্গলবার ডেকে পাঠায় ইডি।