ব্রতদীপ ভট্টাচার্য, কলকাতা : ঘড়িতে তখন সকাল আটটা। ইকবালপুর এলাকার একটি স্কুলে লাইন দিয়ে ঢুকে যায় খুদে পড়ুয়ারা। তার পর গোটা এলাকা শান্ত। গেটের উল্টো দিকে সার দিয়ে দাঁড়ানো সব স্কুল বাস। ট্র্যাফিক সার্জেন্টরা স্কুলের ভিড় সামলে এবার অফিস টাইমের জ্যাম সামলাতে তৎপর। প্রায় আধ ঘণ্টা পর হঠাৎ ওই বাসগুলির মধ্যে থেকে এক শিশুর কান্নার শব্দ শোনা যায়। কিছুটা সময় যেতেই কান্না আরও তীব্র হয়। কর্তব্যরত সেই ট্রাফিক সার্জেন্টরা ছুটে গিয়ে দেখেন, স্কুল গেটের উল্টো দিকে দাড়িয়ে থাকা বাসগুলির একটিতে আটকে রয়েছে এক শিশু। গরমে ঘেমে নেয়ে বিধ্বস্ত সে। ট্রাফিক সার্জেন্টদের দেখে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করে পড়ুয়া। একটাই কথা, " আমাকে এখান থেকে বের করো। আমি বাড়ি যাব।"
শুক্রবার সকালে এমনই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে ইকবালপুর মোড়ের কাছে। নার্সারির পড়ুয়াকে বাসে আটকে রেখে চলে যায় বাস ড্রাইভার ও হেল্পার। বাসে উঠে ঘুমিয়ে পড়েছিল ছোট্ট পড়ুয়া। তার পরিবারের লোকেদের অভিযোগ, বাকি পড়ুয়াদের বাস থেকে নামিয়ে আর চেক করেনি ড্রাইভার। আর সেই অবস্থাতেই ওই খুদে পড়ুয়াকে বাসে ফেলে রেখে দরজায় তালা দিয়ে চলে যায় তারা। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, সকাল আটটা নাগাদ যে স্কুল বাসে ওই পড়ুয়া আসে, সেই বাসের বাকিরা স্কুলে ঢুকে যায়। তখন থেকে বাসে বন্দি পাঁচ বছরের ওই শিশু। তীব্র গরমে যখন কাঁদতে শুরু করে তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে আটটা পেরিয়েছে। অর্থাৎ প্রায় আধ ঘন্টা বাসে আটকা ছিল সে।
ওই স্কুলের সামনেই ডিউটি করছিলেন বিদ্যাসাগর ট্রাফিক গার্ডের দুই সার্জেন্ট অরিত্র মুখোপাধ্যায় ও পলাশ হালদার। শিশুটির কান্নার শব্দ পেয়ে তারাই গিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। সার্জেন্ট অরিত্র জানান, বাসটির দরজায় তালা দেওয়া ছিল। ড্রাইভারকে অনেক খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে শিশুটিকে কোনওভাবে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। এমনিতে গরমে নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল তার। তার উপর কেঁদে কেঁদে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। আমরা দুজনে তখন ওই বাসের একটি জানলা বহু কষ্ট টেনে খুলি। আর সেখান দিয়ে শিশুটিকে উদ্ধার করি।"
ট্রাফিক পুলিশের তরফ থেকে বিষয়টি স্কুলে জানানো হয়। খবর দেওয়া হয়, ওই শিশুর বাড়িতেও। শিশুটির মা জানান, 'অন্যদিন বাসের যে হেলপার থাকেন, তিনি আজ ছিলেন না। ওই গাড়ির মালিক নিজে হেলপারের জায়গায় ছিলেন। আমরা স্কুল থেকে খবর পাই। খুবই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমরা তো স্কুল বাসে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি। এমন কিছু হবে ভাবতেও পারিনি। '
বাসের মালিককে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সাফাই, 'সব ঠিকই ছিল। বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছিল। দেখিনি। বাসটা পার্ক করে দেওয়া হয়েছিল। পঁচিশ বছর ধরে এই কাজ করছি। এক আধটা ভুল হয়ে যেতেই পারে। তবে ভবিষ্যতে আর হবে না এই চেষ্টাই করব।'
স্কুলের প্রিন্সিপাল জানিয়েছেন , 'বাসের মালিকের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। কী কারণে এই ঘটনা ঘটল, কার গাফিলতিতে, তা বিস্তারিতভাবে জানতে চাওয়া হয়েছে। উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
স্কুল বাস বা পুল কারের বিরুদ্ধে এহেন অভিযোগ প্রথম নয়। বেহাল গাড়িকে পুল কার হিসাবে ব্যবহার, স্কুল বাসের স্বাস্থ্য, বাসে বা গাড়িতে রিসোল টায়ারের ব্যবহার, বেপরোয়াভাবে চালানোর একাধিক অভিযোগ উঠে এসেছে অতীতে। তাই অভিভাবকদের তরফ থেকে বার বার দাবি উঠেছে, পুল কার বা স্কুল বাসে পড়ুয়াদের সুরক্ষার বিষয়ে আরও একটু কঠোর হোক সরকার ও স্কুল কর্তৃপক্ষ।