পল্লবী দে, কলকাতা: রবিনহুড (Robinhood) নাম শুনলেই মনে ভেসে ওঠে বিখ্যাত চরিত্র। ইংরেজি লোকসাহিত্যর (English Folklore) হিরো তিনি। ধনীদের থেকে সম্পত্তি নিয়ে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া সেই চরিত্র বিশ্বে জনপ্রিয়। তবে সব কাহিনী কি কেবল গল্প হয়? গল্পের চরিত্রদের কি বাস্তবে থাকতে নেই? এই প্রশ্নের উত্তরই দেন কলকাতার রবিনহুডেরা। এবার সেই গল্পেই ডুব দেওয়া যাক।
রাতের আলোয় মহানগর যতটা উজ্জ্বল তিলোত্তমা, স্ট্রিট লাইটের নীচে অন্ধকার ততটাই। সেখানে আলো পৌঁছয় না, পেটের জ্বালা জ্বলতেই থাকে। মহানগরের পূর্ণিমার চাঁদ তাঁদের জীবনে একেবারেই জ্বলসানো রুটি। আসলে 'এই শহর জানে' তাঁদের সবকিছু। সেই সবকিছুর কিছুটা পূরণের দায়িত্ব তুলে নেন শহরেরই একদল রবিনহুডেরা। ক্ষুধার্ত মুখগুলিতে খাওয়ার তুলে দেওয়ার মতো এক গুরুদায়িত্ব। ২০১৪ সাল থেকে সারা ভারত জুড়ে এই কাজ শুরু করেছেন তাঁরা। নীল ঘোষ এবং আনন্দ সিনহার উদ্যোগে শুরু হয়ে এই কাজ। তবে শুধু কলকাতা নয়, সারা দেশের নানা শহরেই ছড়িয়ে রয়েছেন রবিনহুড আর্মিরা।
কীভাবে কাজ হয়? অনুষ্ঠান থেকে রেস্তোরাঁ, খাবার অতিরিক্ত হয় অনেক জায়গায় । ফেলেও দেন অনেকে। কিন্তু সেই খাবার ফেলে না দিয়ে তা শহরের একাধিক ক্ষুধার্ত মুখে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন রবিনহুড আর্মিরা। খাবার ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে তা স্ট্রিটলাইটের অন্ধকারে যাঁদের বাস তাঁদের কাছে পৌঁছে দেওয়াই লক্ষ্য। কলকাতায় রবিনহুড আর্মির সদস্য সৈয়দ মঞ্জুর রহমান জানান, "বিয়েবাড়ি হোক কিংবা রেস্তোরাঁ থেকে বেচে যাওয়া যে ভাল খাবার থাকে সেখানে তা সংগ্রহ করি আমরা। স্টোরেজের কোনও বিষয় রাখি না। সরাসরি সংগ্রহ কর সেই সব খাবার পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে নিয়ে তা পৌঁছে যাই। ২৭০টির বেশি শহরে আছি আমরা। প্রায় প্রতিদিনই এই কাজ করি। অনেকসময় তা সম্ভব না হলেও সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনও রয়েছে সেই দিন আমরা খাবার পৌঁছে , দেবই। সেক্ষেত্রে কোনও বেচে যাওয়া খাবার না থাকলেও আমরা নিজেরাই খাবার কিনে সেই কাজ অব্যাহত রাখি।" উল্লেখ্য এবিপি আনন্দ আয়োজিত 'খাইবার পাস'-এও অংশগ্রহণ করেছিলেন রবিনহুড আর্মিরা। অনেকেই সেখানে এসে খাবার দিয়ে গিয়েছিলেন রবিনহুডদের মাধ্যমে সমাজের সেই সকল মানুষদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।
'খাইবার পাস'- এ ছিলেন এ শহরের 'রবিনহুড'রা
আরও পড়ুন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জল খান? অজান্তেই ক্ষতি ডেকে আনছেন না তো?
গল্পের রবিনহুডের মতো তাঁরা দুরন্ত তিরন্দাজ না হলেও ভালোবাসার তির গেঁথেই হাসি এনে দেন সেই সকল মানুষদের মুখে, যারা দু-মুঠো অন্ন জোগাতে অক্ষম। রবিনহুড আর্মির এই সদস্যর কথায়, " আমরা যেমন রেস্তোরাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখি, তেমন অনেকেই আছেন যারা খাবার দানও করেন। অনেকে খবরও দেন খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেক্ষেত্রে আমরা গিয়ে খাবার নিয়ে এসে তা বিতরণের কাজ করি। রবিনহুডে কিন্তু টাকাপয়সার কোনও লেনদেন নেই। আমরা টাকা নিতে পারিনা, কেবল খাবার নিতে পারি। এটা পুরোটাই ভলান্টিয়ার ভিত্তিক কাজ। যারা এখানে কাজ করে তা নিজেদের ফ্রি টাইমে কাজ করে। বয়সের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। যে কেউ আমাদের সঙ্গে কাজ করতে যোগ দিতে পারেন।"
আমাদের বহুমুখী সমাজে 'বিবিধের মাঝে মিলন' যেমন রয়েছে তেমন নানা মতও রয়েছে। তবে কি এই কাজের ক্ষেত্রে বাস্তবের রবিনহুডরা বাধা পান, পড়তে হয় কোনও কড়া শাসনের মাঝে? এ প্রশ্নের উত্তরে মঞ্জুর রহমান বলেন, "আমরা সচেতনতামূলক প্রোগ্রামগুলি করতেই থাকি। অনেক বড় রেস্তরাঁও আছে যারা সাহায্য করে। এগিয়ে আসেন। তবে এটাও ঠিক অনেককে বোঝাতে সময়ও লাগে। কিন্তু কাউকে বললে কেউ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে এখনও সেরকম পাইনি। বরং সকলেই কিন্তু এগিয়ে এসেছেন, খাবার দিয়েছেন। করোনার সময় একদম গ্রামে গ্রামে গিয়ে খাবার দিয়ে এসেছি। চাল, ডাল, শস্য দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এখন পুরো কাজ, যোগাযোগ হয় সোশাল মিডিয়া হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে।"
গল্পের শেষেও যেন থেকে যায় বাস্তবের সেই গল্প। গল্পের রবিনহুডের মানসিকতা ছিল- 'আমরা সবাই রাজা'র ধরনের। আর বাস্তবের রবিনহুডেরা জানেন পেটের খিদের কাছে রাজা-প্রজা-মন্ত্রী-সান্ত্রী ভেদ থাকে না, যা থাকে তা সবার মাঝে সবাইকে নিয়ে বাঁচার।