মনোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর: শিল্পনগরী দুর্গাপুরের ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের অবসান। ডিপিএল-এর কোকওভেন ইউনিট বন্ধ হয়েছিল আগেই, এবার ভেঙে ফেলা হল রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা এই সংস্থার বিশালাকার কোল গ্যাস চেম্বার। শোকের আবহ শিল্পনগরীতে। শিল্প রক্ষা এবং নতুন শিল্প করা নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা।


সময়টা ১৯৫৮, দুর্গাপুর শহর সেই সময় ছিল জঙ্গলে ঘেরা। কেউ ভাবতেও পারত না এখানে কোনও শিল্প হতে পারে। এই শহরের মাটিতে শিল্পায়নের পতাকা তোলেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায়। দুর্গাপুরে তৈরি হয় ডিপিএল বা দুর্গাপুর প্রজেক্ট লিমিটেড। রাজনীতির বিভাজন ভুলে দুর্গাপুরের শিল্পায়ন আর কর্মসংস্থানের প্রশ্নে সবাই এক হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৫৮সালে তৈরি হয় ডিপিএল-এর কোকওভেন ইউনিট। কিন্তু কোকওভেন ইউনিটে যে কোল গ্যাস তৈরি হবে তা কোথায় মজুত করা হবে? এই প্রশ্নের উত্তরের সমাধান সূত্র বেরোয়। তৈরি হয় কোল গ্যাস চেম্বার। বিশাল আকৃতির উঁচু সেই কোল গ্যাস চেম্বারের মাথায় লেখা ছিল ডিপিএল। আর যে চেম্বার ছিল শহর দুর্গাপুরের একটি বিশেষ নির্দেশন। জাতীয় সড়ক ধরে গেলে বা শিল্পাঞ্চল দুর্গাপুরের কোনও ল্যান্ডমার্ক বোঝাতে গেলে সবাই এই বিশাল আকৃতির কোল গ্যাস চেম্বারকেই বুঝতেন। এই চেম্বার থেকে একটা পাইপ লাইন চলে গিয়েছিলো হওড়ার বালি পর্যন্ত।


রাজ্য সরকারের অধীনে থাকা ডিপিএলের কোকওভেন ইউনিটের উৎপাদিত কোল গ্যাস এই চেম্বার থেকে মাটির নিচে থাকা এই পাইপ লাইনের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে হাওড়ার বালি পর্যন্ত আর অন্য কয়েকটি পাইপলাইন শহর দুর্গাপুরের বিভিন্ন কারখানা, যেমন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা বা ডিএসপি, মিশ্র ইস্পাত কারখানা, আরও ছোট-বড় বেশ কয়েকটি কারখানায় পৌঁছে যেত। ইস্পাত গলানোর ক্ষেত্রে এই কোল গ্যাস সদর্থক ভূমিকা নিত আর খরচও কম পড়ত। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্যাসের চাহিদাও ছিল তাই অনেক। শুধু এই কোল গ্যাস উৎপাদন করেই কোটি কোটি টাকা আয় করত ডিপিএল। কিন্তু সুখের এই দিনে যবনিকা পড়ল ২০১৫ সালে। লোকসানে চলা ডিপিএল-এর এই ইউনিট বন্ধ করে দেওয়া হল। ইউনিটের শ্রমিকদের ডিপিএলের পাওয়ার প্লান্ট সহ অন্যান্য সরকারি দফতরে বদলি করে দেওয়া হল।


১৯৫৮সালে যে কোকওভেন ইউনিট এর যাত্রা শুরু হয়েছিল তার যবনিকা পড়েছিল ২০১৫ সালে। আর যবনিকার সেই কফিনে পেরেক পড়লো ২০২০ সালে। নিলামে তোলা হল একের পর এক যন্ত্রাংশ। শেষ পরিণথি ঘটল এবার। ভেঙে দেওয়া হল ১৯৫৮সালে তৈরী সেই বিশাল কোল গ্যাস চেম্বার, যা ছিল শহর দুর্গাপুরের এক নিদর্শন।


একটা একটা করে শহরবাসীর স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল চোখের সামনে। বিশেষ করে ডিপিএল-এর প্রাক্তন কর্মীদের জন্য এ যেন এক শোকের দিন। যে প্রকল্প নতুন প্রজন্মের কাছে যা হতে পারত কর্মসংস্থানের এক সিম্বলিক আইকন, আজ তাই যেন রাতারাতি হয়ে গেল এক ধ্বংসাবশেষ।


দোষারোপ পাল্টা দোষারোপের রাজনীতির সাত সতেরোর মারপ্যাঁচের জটিল অঙ্কের হিসেব কষতে যখন ব্যস্ত রাজনীতির  কারিগররা, তখন দেখতে দেখতে একটা অধ্যায়ের অবসান হল শহরবাসীর চোখের সামনে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল একটা শিল্প।