ঋত্বিক প্রধান, পটাশপুর: আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তোলপাড় রাজ্য। সেই আবহেও একের পর এক নারী নির্যাতন, মেয়েদের উপর নারকীয় অত্যাচারের ঘটনা সামনে আসছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরের পর এবার পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে গৃহবধূকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ এবং জোর করে কীটনাশক খাইয়ে খুনের অভিযোগ উঠল প্রতিবেশী যুবকের বিরুদ্ধ। এই প্রথম নয়, এর আগেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এমন এধাকিক অভিযোগ ওঠে। (Bhupatinagar Case)


জানা গিয়েছে, নির্যাতিতা ভগবানপুর বিধানসভা এলাকার বাসিন্দা। কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন তাঁর স্বামী। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, গ্রামেরই এক ব্যক্তি বাড়ি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যান ওই গৃহবধূকে। ওই গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়। বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়ে যায়, ওই গৃহবধূ যাতে কাউকে কিছু না বলতে পারেন, তার জন্য ধর্ষণের পর গৃহবধূর মুখে কীটনাশক ঢেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। (Purba Medinipur News)


স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কীটনাশক খাওয়া অবস্থাতেই ওই গৃহবধূকে উদ্ধার করেন গ্রামবাসীরা। স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় ওই গৃহবধূর। বিষয়টি সামনে আসতেই এলাকায় জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত জনতা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে বের করে এনে গণধোলাই দেয়। সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও।


খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় পটাশপুর থানার পুলিশ। সেখানে পুলিশকে ঘিরেও বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়রা। অভিযুক্তকে এলাকায় আটকে রাখা হয়েছে এই মুহূর্তে। ঘটনাস্থলে রয়েছে পুলিশও। পুলিশকে ঘিরে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন গ্রামবাসীরা। তাঁদের দাবি, অবিলম্বে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করতে হবে। কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।


আর জি কর কাণ্ডের পরও এই ধরনের ঘটনা সামনে আসছে লাগাতার। ৯ বছরের শিশুকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে শনিবার উত্তাল হয়ে ওঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগরও। টিউশন পড়তে যাওয়া মেয়েটিকে ধর্ষণ ও খুনের পর ক্ষতবিক্ষত দেহ জমির ধারে ফেলে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ সামনে এসেছে। গোটা ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। মেয়েটি নিখোঁজ হওয়ার পরই থানায় গেলে, পুলিশ টালবাহানা করে বলে অভিযোগ। অন্য থানায় যেতে বলা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ পদক্ষেপ করলে মেয়েটির প্রাণ চলে যেত না বলে মনে করছেন তাঁরা। সেই নিয়ে শনিবার ধুন্ধুমার বাধে। পুলিশ ফআঁড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়।


এবার পটাশপুর থেকে একই ঘটনা সামনে এল। বিষয়টি সামনে আসতেই অশান্তি ছড়িয়েছে এলাকায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে পটাশপুর থানার বিরাট পুলিশ বাহিনী। পুলিশকে ঘিরেও বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন স্থানীয়রা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবি, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক অভিযোগ ওঠে। সেই নিয়ে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। আর তাতেই এই অবস্থা। মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করে যথাযথ পদক্ষেপ করতে হবে বলে দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও গিয়েছেন সকলে।


এ নিয়ে বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "এগুলিকে সামাজিক বিচ্যুতি বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে আর দূরে থাকতে পারব না। চার দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক সমাজের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি আমরা, বাধ্যতার সংস্কৃতির বাসিন্দা হয়ে গিয়েছে। এই ধরনের ঘটতে পারে, ধর্ষণের ঘটনা কাঙ্খিত না হলেও, ধর্ষণমুক্ত সমাজ ভাবা যায় না। কিন্তু পুলিশ কী করছে, কী শাস্তি হচ্ছে, বিকৃতমনস্ক মানুষদের ভয় পাওয়ানো যাচ্ছে কি মা, তা-ই আসল ব্যাপার। এই ধরনের ঘটনা ঘটছে কারণ হল সমস্ত দুষ্কৃতী আজ নিয়ন্ত্রণহীন সমাজে থেকে, আইনের শাসন না থাকায় ভয়মুক্ত হয়ে গিয়েছে। ভাবছে, সরকার তাদের, তাই পুলিশ কিছু করতে পারবে না। পুলিশও আক্রান্ত হচ্ছে। পুলিশের এমনই পরিণতি হওয়ার কথা ছিল। উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকদের সরীসৃপ হয়ে যাওয়ার কারণে, আত্মসমর্পণের কারণে, উদাসীনতার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আজ এটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। কারও মনে ভয় বলে আর কিছু নেই। একদিকে মৌলবাদ চেপে বসছে বুকের উপর, তৃণমূলের পতাকা নিয়ে যা খুশি করা যায় ভাবা হচ্ছে। অপরাধীরা মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারণ তারা দেখেছে কামদুনি কাণ্ডে কিছু হয়নি। এমন ভাবে তদন্ত করা হয়, যাতে অপরাধীরা মুক্তি পেয়ে যায়।"


সিপিএম-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "পশ্চিমবঙ্গে যা চলছে, আমাদের মুখ দেখানোর সুযোগ কমে যাচ্ছে। ভয়াবহ। বাড়ছে। অপরাধীরা যেন মনে করছে, যা খুশি করতে পারে, কেউ কিছু করার নেই। আর জি কর নয় শুধু, নানা ঘটনার বিস্ফোরণ ঘটে আর জি করে। কিছু লাভ হল না। জয়নগরে বাচ্চা মেয়ে, এখন পটাশপুরে গৃহবধূ। কোথায় যাচ্ছি আমরা? কী করে এত সাহস পাচ্ছে? পার্ক স্ট্রিট থেকে ছোট ঘটনা বলা শুরু হয়। ধূপগুড়ি, কাকদ্বীপ, কামদুনি, হাঁসখালি...মেয়েটির চরিত্র চিত্রণ হয়ে গেল। কামদুনিতে সবাই কার্যত ছাড়া পেয়ে গেল। সরকার রাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে এমন ভাবে চলল, যেখানে তদন্তে গন্ডগোল করা যায়, ধামাচাপা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা যায়। যারা করে তারা কলকাতার পুলিশ কমিশনার হয়। এতকিছুর পরও লজ্জা হচ্ছে না? এর শেষ কোথায়? ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে রয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী আরও উৎসাহিত হয়ে নিশ্চয়ই উৎসবে মেতে উঠবেন। একদিকে মায়ের কোল খালি হচ্ছে, অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী উৎসবে নেচে বেড়াচ্ছেন। আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। সরকারের যখন এমন হাবভাব, মানুষকেই রুখে দাঁড়াতে হবে।"