সঞ্চয়ন মিত্র, কলকাতা : ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৬ – ১৬ই আগস্ট, ১৮৮৬ । শ্রীরামকৃষ্ণদেবের লীলায় ধন্য হয়েছিল বঙ্গভূমি। ৭ মে ১৮৬১ – ৭ আগস্ট ১৯৪১। কবিগুরুর সৃষ্টির ছায়ায় সমৃদ্ধ হয়ে ছিল বাংলার মাটি, বাংলার জল। দুই মহামানব একই সঙ্গে ছিলেন বাংলায়। তাঁদের কি কখনও সাক্ষাৎ হয়েছিল? হয়েছিল, ভাবের আদান-প্রদান? এ প্রশ্ন অনেকের। হ্যাঁ, দুই জ্যোতিষ্ক পাশাপাশি এসেছিলেন, আজকের এই দিনেই। 


শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথের দেখা হলেও কথা হয়নি। এই সেই দিন, যেদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুখোমুখি হয়েছিলেন কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনও কথা হয়নি বলেই জানা যায় । কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয়েছিল সেই সাক্ষাৎ ? ২ মে, ১৮৮৩। শ্যামবাজারের কাছে নন্দনবাগানে কাশীশ্বর মিত্রের বাড়িতে ব্রাহ্ম মহোৎসবের আয়োজন। 

কাশীশ্বর মিত্র আদি ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন। নিজের বাড়িতেই দোতলার একটা বড় ঘরে ঈশ্বরের উপাসনা করতেন, আর ভক্তদের আমন্ত্রণ করে মাঝে মাঝে উৎসব করতেন। তিনি মারা যাবার পর তাঁর ছেলে শ্রীনাথ, যজ্ঞনাথরা কিছুদিন একই রকম উৎসব পালন করেছিলেন। তাঁদেরই আমন্ত্রণে সেবার শ্রীরামকৃষ্ণের সেখানে যাওয়া।


শ্রীরামকৃষ্ণ আমন্ত্রিত হয়ে রাখাল (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) এবং মাস্টার (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) কে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। প্রথমে তাঁদের নিচের ঘরে বসানো হয়। সেখানে ব্রাহ্মসমাজের আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধের উপাসনার আগে ওপরের ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের ডাক পড়ল।

তিনি ভক্তদের নিয়ে ওপরে গেলেন। ঘরের একদিকে উপাসনা বেদী। ঠাকুর ঘরে ঢুকে প্রথমে সেই বেদীতে প্রণাম করলেন। তারপর একপাশে গিয়ে বসলেন। তাঁকে ঘিরে আরো বেশ কিছু মানুষ বসেছেন। তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ থেকে ঈশ্বর প্রসঙ্গে কিছু কথা শুনতে চান। ঠাকুর খানিকক্ষণ  ব্রাহ্ম ভক্তদের সঙ্গে ধর্মপ্রসঙ্গ আলোচনা করলেন। উপস্থিত ভক্তদের বললেন মাঝে মাঝে এমন একসঙ্গে ঈশ্বর চিন্তা ও তাঁর নামগুণ কীর্তন করা খুব ভাল।


আরও খানিক পরে ব্রহ্ম উপাসনা শুরু হল। ঘরের একদিকে পিয়ানো ও হারমোনিয়াম রাখা। সেখানেই গানের দল ব্রহ্মসঙ্গীত শুরু করল। ওই অনুষ্ঠানের নেতৃত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর তখন মাত্র ২২ বছর বয়স। সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর কোনো কথাই হয়নি। এই একবারই দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাতের কথা নথিবদ্ধ রয়েছে।


পরবর্তী সময়ে বহু মানুষ বিভিন্ন সময়ে রবীন্দ্রনাথকে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করতে বা দু-চার কথা লিখতে অনুরোধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কখনোই এই ক্ষণিক দেখা এবং অন্যের মুখে শোনার ভিত্তিতে শ্রীরামকৃষ্ণের মূল্যায়ণ করতে রাজি হননি। শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় যে ধর্মমহাসভার আয়োজন করা হয়েছিল তাতে ১৯৩৭-এর ৩রা মার্চ ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেদিনের বক্তৃতার শেষে রবীন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে এই কবিতাটি পড়েন।

“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।
তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে,
নতুন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে।
দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি,
সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।” এই কবিতা শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে শুধুমাত্র কবির মূল্যায়নই ব্যক্ত করে না, শ্রীরামকৃষ্ণের সমগ্র জীবন আমাদের কাছে বিন্দুতে সিন্ধু রূপে তুলে ধরে। 


আরও পড়ুন