রাজা চট্টোপাধ্যায়, জলপাইগুড়ি: জলপাইগুড়িতে নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন ও তাঁর স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। ভাইরাল সুইসাইড নোট ঘিরে শোরগোল। অস্বাভাবিক মৃত্যুর নেপথ্যে ছয় বছর আগের শিশুপাচারকাণ্ড? ভাইরাল সুইসাইড নোটকে হাতিয়ার করে তৃণমূলকে নিশানা বিজেপির। পাল্টা জবাব দিয়েছে শাসক শিবির।
৬ বছর আগে যাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে জলপাইগুড়িতে শিশুপাচার চক্রের পর্দাফাঁস হয়েছিল, সস্ত্রীক সেই ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুতে দানা বাঁধছে রহস্য। জলপাইগুড়ি জেলার নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন সুবোধ ভট্টাচার্য ও তাঁর স্ত্রী অপর্ণা ভট্টাচার্যর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্য রাজনীতিতে। শনিবার সকালে জলপাইগুড়ির পাণ্ডাপাড়া এলাকার এই বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় দম্পতির মৃতদেহ।
ঘটনার পরে পরই ভাইরাল হয়েছে চারপাতার একটি দীর্ঘ সুইসাইড নোট, যার ছত্রে ছত্রে বিস্ফোরক অভিযোগ করা হয়েছে! ভাইরাল সুইসাইড নোটের সত্যতা যাচাই করেনি এবিপি আনন্দ। তবে এই চিঠিকে হাতিয়ার করেই, জলপাইগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান ও যুব তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায়-সহ চারজনের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ দায়ের করেছেন ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বিজেপি বিধায়ক শিখা চট্টোপাধ্যায়।
তিনি আবার সম্পর্কে মৃত সুবোধ ভট্টাচার্যর দিদি। ভাইরাল সুইসাইড নোটে সুবোধ ভট্টাচার্যর স্ত্রী অপর্ণা ভট্টাচার্যর বয়ানে লেখা হয়েছে, ২০১৭ সালে শিশুপাচার চক্রের পর্দাফাঁস করায় তাঁদের দীর্ঘদিন ধরে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছিল। জোরজবরদস্তি নগদে ৫ লক্ষ টাকা নেওয়া হয়। এমনকি শিশুপাচার চক্রের পর্দাফাঁস করার খেসারত হিসেবে তাঁদের বিরুদ্ধে ২০ লক্ষ টাকায় চাকরি বিক্রির মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে।
ষড়যন্ত্রকারীদের দাবিমতো টাকা দিতে না পারায়, জমির দলিল ও ব্ল্যাঙ্ক চেক জমা দিতে হয়েছে। এই চাপের মুখেই তাঁরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে দাবি করা হয়েছে সুইসাইড নোটে। পুরো ঘটনায় কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি, আইনজীবী ও পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান সৈকত চট্টোপাধ্যায়-সহ চার জনকে।
ডাবগ্রাম ফুলবাড়ির বিজেপি বিধায়ক শিখা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, চারপাতার সুইসাইড নোটে অভিযোগ। আত্মহত্যায় প্ররোচনা। এরাই প্রেসার দিচ্ছিল আমার ভাইকে ও ভাইয়ের বউকে। এরা শিশুপাচারকাণ্ডে যুক্ত ছিল। প্রভাবশালী বলে গ্রেফতার করেনি। ব্ল্যাকমেল করছিল।
জলপাইগুড়ির যুব তৃণমূলের উপ পুরপ্রধান ও জেলা সভাপতি সৈকত চট্টোপাধ্যায় বলছেন, এই হ্যান্ডরাইটিং যদি অপর্ণা ভট্টাচার্যর হয়ে থাকে,তাহলে আমি রাজনীতি থেকে অবসর নেব। এক্সপার্টের কাছে এই সুইসাইড নোট পাঠানো হোক। ২০০০-০২ সাল ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে জিতে ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন জলপাইগুড়ি পুরসভার। ওনার অনেক নথি আমাদের কাছে আছে।
২০১৭ সালে জলপাইগুড়ি জেলা নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের চেয়ারপার্সন পদে ছিলেন সুবোধ ভট্টাচার্য। তাঁর কার্যকালেই জেলায় বড় শিশুপাচারচক্রের পর্দাফাঁস হয়। সিআইডি সূত্রে দাবি, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাথায় বসে, দীর্ঘদিন ধরে, দত্তক দেওয়ার নাম করে শিশুপাচার চক্র চালাচ্ছিলেন জলপাইগুড়ির একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা চন্দনা চক্রবর্তী। আশ্রয় ও বিমলা নামে দুটি হোম থেকে দত্তকের নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিদেশেও শিশু পাচার করা হত বলে অভিযোগ ওঠে। সিআইডি-র তদন্তে উঠে আসে সর্ষের মধ্যেই ভূতের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অভিযুক্ত শিক্ষিকা চন্দনা চক্রবর্তীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, উচ্চতর আধিকারিকরা জড়িত। তৎকালীন CWC চেয়ারপার্সন সুবোধ ভট্টাচার্যই বিষয়টি রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরে জানিয়েছিলেন।
জলপাইগুড়ির নারী ও শিশুকল্য়াণ দফতরের তৎকালীন চেয়ারপার্সন সুবোধ ভট্টাচার্যের কথায়, ২৩ ফেব্রুয়ারি নারী ও শিশুকল্যাণ দফতরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারিকে জানাই। জুনে ডিএমকে অভিযোগ। কারও কাছে এক লক্ষ, কারও কাছে, ৩ লক্ষ। বাচ্চা দেয়নি। এহেন প্রাক্তন আধিকারিকের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর।
শিখা চট্টোপাধ্যায় আরও বলেন, মেয়ের বিয়ের সময় ২০ লক্ষ টাকা চায়। দিতে না পারায় ব্ল্যাঙ্ক চেক ও জমির দলিল নিয়ে নেয়। সৈকতের প্রেসারেই গেল দুজন। সিবিআই চাইবে কিনা, দল ভেবে দেখবে। পুলিশকে সাতদিন সময় দিলাম গ্রেফতারের জন্য। সবমিলিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ রয়েছেই। তদন্তে শেষ পর্যন্ত কী উঠে আসে, সেটাই দেখার।