কলকাতা: ৭৯ বছরেও তরতাজা যুবক। শক্তির নিরিখে অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে বয়সে কম অনেককেই। কলকাতায় এলে দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অবশ্যই পড়ে এটি। বলা হচ্ছে হুগলি নদীর উপর থাকা হাওড়়া ব্রিজের কথা। ১৯৪৩ সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল হাওড়া ব্রিজ। তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত টানা পরিষেবা দিয়ে আসছে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যার অন্যতম নির্দশন এই সেতু। ১৯৪৩ সালে পথচলা শুরু হলেও এর ইতিহাস আরও প্রাচীন। দেখে নেওয়া যাক হাওড়া ব্রিজ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য।
একটিও নাট-বল্টু নেই
সাতশো মিটারেরও বেশি লম্বা, ৩০ মিটার চওড়া এই বিপুল আকারের ব্রিজটি তৈরিতে ব্যবহার হয়নি একটিও নাট-বল্টু। ধাতব পাত জুড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে এই ব্রিজ।
ঝুলন্ত ব্রিজ
গোটা ব্রিজ তৈরিতে নদীর মাঝে কোনও পিলার ব্যবহার করা হয়নি। এই পদ্ধতিতে তৈরি ব্রিজকে বলা হয় সাসপেনসন টাইপ ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার ব্রিজ (suspension-type balanced cantilever bridge)। যখন এটি তৈরি হয় তখন এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ ছিল। বর্তমানে এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ।
প্রথমে অন্য চেহারা
একদম প্রথমে হুগলি নদীর উপর ছিল পল্টুন ব্রিজ। সেটা ১৮০০ শতকের ঘটনা। তারপর থেকে ইংরেজ আমলে ক্রমশ বেড়ে চলেছে কলকাতা। প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কাজের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে কলকাতা শহর। তখন বড় ব্রিজ তৈরির করার ভাবনা আসে ইংরেজ শাসকের মাথায়।
হাওড়া স্টেশন হওয়ার পর
ইতিহাস বলে প্রথমে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা ছিল না। কী ব্রিজ তৈরি হবে তা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। কিন্তু সেগুলি কখনই বাস্তবের মুখ দেখেনি। ১৯০৬ সালে হাওড়া স্টেশন তৈরির পর বেড়ে যায় হুগলি নদীর উপর একটি বড় সেতুর প্রয়োজনীয়তা।
দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল
ব্রিজ তৈরির জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছিল। কিন্তু বাদ সাধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিজের খরচার কথা ভেবে পিছিয়ে আসে শাসক ইংরেজ। পরে ফের শুরু হয় কাজ। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি জার্মান সংস্থা দায়িত্ব পেয়েছিল। কিন্তু, ততদিনে বিশ্বজুড়ে বদল হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাতিল করা হয় সেই দরপত্র। ব্রিজ তৈরির দায়িত্ব পায় ব্রেথওয়েট বার্ন (Braithwaite Burn) এবং জেসপ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (Jessop Construction Company Limited)। কাজ শুরু হয় ১৯৩৬ সালে। ঠিক করা হয় তৈরি হবে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা
যখন হাওড়া ব্রিজের কাজ চলছে, তখনই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফলে ফের টাকার জোগানে টান পড়ে। যদিও সব বাধা কাটিয়ে দীর্ঘ ৬ বছর কাজের পর, ১৯৪২ সালে আজকের চেহারায় গড়ে ওঠে হাওড়া ব্রিজ।
ভারতের অবদান
ব্রিজ তৈরির জন্য ইস্পাত আসার কথা ছিল ইংল্যান্ড থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য, জাহাজ আসতে সমস্যা তৈরি হয়। প্রয়োজনের তুলনায় খুব অল্প ইস্পাত পাওয়া যায়। এদিকে কাজ তো করতেই হবে। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসে ভারতের প্রতিষ্ঠান জামশেদজি নাসেরজির তৈরি টাটা সংস্থা। টাটার ইস্পাত কারখানা থেকে আসা ২৩০০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে হাওড়া ব্রিজে।
১৯৪৩-এ শুরু পথচলা
১৯৪৩ সালে সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য খুলে দেওয়া হয় হাওড়া ব্রিজ। কিন্তু কোনও অনুষ্ঠান করা হয়নি। কারণ তখন তুঙ্গে উঠছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পার্ল হারবারে বোমাবর্ষণ করেছে জাপানি বোমারু বিমান। হাওড়া ব্রিজও যাতে আক্রমণের শিকার না হয়, তার জন্য সাধারণভাবেই শুরু হয়েছিল এই ব্রিজের পথচলা। শোনা যায়, যুদ্ধের প্রয়োজনে নতুন ব্রিজটিকে বিস্ফোরণ করে উড়িয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা ছিল ইংরেজের। কিন্তু অক্ষশক্তির হার বাঁচিয়ে দেয় হাওড়া ব্রিজকে।
প্রথম ছিল ট্রাম
এখন প্রতিদিন লাখ লাখ লোক হেঁটে পারাপার করেন হাওড়া ব্রিজ। চলে গাড়ি-বাস। কিন্তু চালু হওয়ার পর প্রথম এই ব্রিজ ধরে নদী পেরিয়েছিল একটি ট্রাম। পরে ট্রাফিক সামলাতে নব্বইয়ের দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয় ট্রাম
নাম বদলে রবীন্দ্র সেতু
১৯৬৫ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে নামাঙ্কিত হয় হাওড়া ব্রিজ। নতুন নাম হয় রবীন্দ্র সেতু। ফলকে নাম বদলালেও, এতদিন পরেও লোকের মুখে মুখে রয়ে গিয়েছে পুরনো নামই।
১৯৪৩ সালের তুলনায় বহরে-ব্যস্ততায় কয়েকশো গুণ বেড়েছে আজকের কলকাতা ও হাওড়া। বেড়েছে ব্যস্ততা। বেড়েছে গাড়ি চলাচলও। তবুও একইরকম ভাবে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে এই সেতু।