‘তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শত রূপে শতবার


জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।


চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার-


কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার


জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।…’


কমলকৃষ্ণ দে, বর্ধমান: বছরভর অপেক্ষা। কাছাকাছি আসার সুযোগ শুধু একদিন। আর তাতেই বেঁধে বেঁধে থাকার অঙ্গীকার। আর সেই অঙ্গীকার থেকেই ‘তত্ত্ব’ আদানপ্রদান। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে এমনই রীতি। সরস্বতী পুজোর পরদিন পরস্পরকে তত্ত্ব পাঠান ছেলেমেয়েরা। আজ বলে নয়, বহু দিন থেকেই চলে আসছে। সরস্বতী পুজোর পর দিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসে কার্যত এভাবেই উদযাপিত হয় প্রেম ও বন্ধুত্ব। (University of Burdwan)


ক্যালেন্ডারে দাগিয়ে দেওয়া না থাকলেও, সরস্বতী পুজো বাঙালির ঘোষিত ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে এই প্রেমদিবস পালিত হয় সরস্বতী পুজোর একদিন পর। বিশেষ দিনটিতে মেয়ে ও ছেলেদের হস্টেলের মধ্যে ‘তত্ত্ব’ বিনিময় হয়, যা বন্ধুত্বের মেলবন্ধন ও প্রেম পূর্ণতা পাওয়ার প্রতীক। পছন্দের মানুষের জন্য এই ‘তত্ত্ব’ পাঠান ছেলেমেয়েরা। (Saraswati Puja at University of Burdwan)


বাঙালির মধ্যে ‘তত্ত্ব’ দেওয়া নেওয়ার প্রথা রয়েছে। তবে এই প্রথা বিবাহ অনুষ্ঠানের অংশ। বিয়ের দিন ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব যায়। মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলের বাড়িতে তত্ত্ব যায় ফুলসজ্জায়। পর পর ডালায় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাজিয়ে পাঠানো হয়। দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের প্রতীক এই তত্ত্ব, যাতে থাকে হলুদ, পোশাক, মাছ, মিষ্টি, ফল, পান-সুপারি, প্রসাধনী। কিছু ক্ষেত্রে তত্ত্বে গয়নাও পাঠানো হয়। 


বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ‘তত্ত্ব’ বিনিময়ের এই রীতি বিবাহ অনুষ্ঠানেরই অনুসারী, শুধু উপলক্ষ্য আলাদা। এখানে ‘তত্ত্ব’ বিনিময়ের মাধ্যমে এক মন ছুঁয়ে যায় আর একটি মনকে। মনের কোণে লুকিয়ে থাকা একান্ত ইচ্ছের প্রকাশ ঘটে। হস্টেলের আবাসিকদের কাছে এ যেন পছন্দের মানুষের প্রতি প্রেমের স্বীকারোক্তি, তাঁকে উপহার দেওয়ার উপলক্ষ্য। 


বছরভর ছেলে এবং মেয়েদের হস্টেলের মধ্যে অবাধ যাতায়াত থাকে না। একমাত্র ব্যতিক্রম সরস্বতী পুজো। এই সময় একে অন্যের হস্টেলে ঢোকার দ্বার অবারিত। অন্য দিন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলেও, বিশেষ দিনে পাল্টে যায় সাজগোজও। জাগ্রত বসন্তে রঙিন শাড়ি, এলোচুল, ফুলের সাজে মোহময়ী হঠেন মেয়েরা। পাজামা-পাঞ্জাবিতে বয়সের তুলনায় পরিণত দেখায় ছেলেদেরও। আপ্যায়নের ব্যস্ততার মধ্যেও মন দেওয়া নেওয়া হয়ে যায় নিভৃতে। আর সেই বন্ধুত্ব, প্রেম স্বীকারোক্তির মাধ্যম হয়ে ওঠে ‘তত্ত্ব’। 


সরস্বতী পুজোর পর দিন প্রথমে ছেলেদের হস্টেল থেকে মেয়েদের মীরাবাই, নিবেদিতা, প্রীতিলতা, সরোজিনী এবং গার্গী হস্টেলে পৌঁছে যায় তত্ত্ব। ফল, মিষ্টি, চিপস, চকোলেট, বাদামে সাজানো থাকে ডালা। এদিন মেয়েদের হস্টেলে ঢুকতে গেলে বাধা পেতে হয় না ছেলেদের। আবার রাত জেদে নিজেদের সাজানো তত্ত্ব বিয়ে মেয়েরাও পৌঁছে যান ছেলেদের অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন, নেতাজি, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্র এবং আইনস্টাইন হস্টেলে। 


রীতিমতো শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাদ্যি সহযোগে তত্ত্ব বিনিময় হয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে। রাস্তার দু’পাশে তখন ভিড়। ছেলেমেয়েদের পথ ছেড়ে দেওয়া হয়। পড়ুয়াদের সাফ কথা, ‘ক্য়াম্পাসেই তো প্রেম হবে!’ এই ‘তত্ত্ব’ আদানপ্রদানের মধ্যে থাকে সুস্থ প্রতিযোগিতাও। আলপনা আঁকা থেকে তত্ত্ব সাজানো নিয়ে পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন ছেলেমেয়েরা। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়, সরস্বতী পুজোর পরদিনই যেন প্রেমদিবস পালিত হয় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে।


ছাত্রাবাসগুলিতেও একই ভাবে উদযাপিত হয় এই তত্ত্ব প্রথা। বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, নেতাজি ছাত্রাবাসের মতো ছাত্রাবাসগুলিতে ছাত্ররা বেঁধে থাকার অঙ্গীকার করেন পারস্পরিক তত্ত্ব আদানপ্রদানের মাধ্যমে।