সৌভিক মজুমদার, অর্ণব মুখোপাধ্যায় এবং রঞ্জিত হালদার, কলকাতা: সুপার নিউমেরারি পোস্ট বা অতিরিক্ত শূন্যপদ প্রসঙ্গে এবার রাজ্যের মন্ত্রিসভার ভূমিকা নিয়েই বড়সড় প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। সোমবার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি বসাক এবং বিচারপতি রশিদির বেঞ্চ বলে, অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছিলেন রাজ্য সরকারের কোন ব্যক্তিরা, তা নিয়ে CBI আরও তদন্ত চালাবে। প্রয়োজনে CBI তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, 'আমার কাছে ক্যাবিনেটের কপি আছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পুরো ক্যাবিনেটকে গ্রেফতার চাইব সিবিআই এর কাছে। হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুপার নিউমেরিক পোস্ট আপনি ক্রিয়েট করেছেন। সিবিআইকে আমি ক্যাবিনেট এর কপি পাঠাবো। সব মন্ত্রী এবং আধিকারিককে কাস্টডিতে নিতে হবে।'
সোমবার কলকাতা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের পর এই প্রশ্নই তুলছেন অনেকে। স্কুলে নিয়োগের ক্ষেত্রে, সুপারি নিউমেরারি পোস্ট অর্থাৎ অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি নিয়ে শুরু থেকেই দানা বেঁধেছিল বিতর্ক। সোমবার রায় দিতে গিয়ে, বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির বেঞ্চ এনিয়ে একেবারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্ত্রিসভাকে বড়সড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিলেন।
কলকাতা হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের ২৬৯ নম্বর পৃষ্ঠায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, অতিরিক্ত শূন্যপদে নিয়োগ নিয়ে CBI তদন্তের উদ্দেশ্য, এটা সামনে আনা যে, এক্ষেত্রে কী ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, কত বড় দুর্নীতি হয়েছে এবং কারা কারা জড়িত। এটা চমকে দেওয়ার মতো যে, জালিয়াতি করে পাওয়া চাকরি বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মন্ত্রিসভার মতো জায়গায়। এটা জেনেও যে, এইসব চাকরি হয়েছে প্যানেলে বাইরে এবং মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া প্যানেলে থেকে।
রায়ের কপির ২৭৩ এবং ২৭৪ নম্বর পৃষ্ঠায় নির্দেশের অংশে বিচারপতিরা বলেছেন, বেআইনি চাকরি প্রাপকদের সুযোগ করে দিতে, অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির ছাড়পত্র দিয়েছিলেন রাজ্য সরকারের কোন ব্যাক্তিরা, তা নিয়ে CBI আরও তদন্ত চালাবে। প্রয়োজন পড়লে CBI তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে।
তমলুকের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, 'এই সুপার নিউমেরারি পোস্ট বানানোয় মন্ত্রিসভার প্রতিটি সদস্য জড়িত। প্রতিটি সদস্য। এটার উদ্য়োগ নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এক অত্যন্ত ঘনিষ্ট জোচ্চর একটি ছেলে আছে, চ্যাংড়া ছোরা, নিজেকে রাজনীতিবিদ বলেন সে। এক্ষুনি তাঁর গ্রেফতারি চাই। এক্ষুনি। তাঁকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।'
এর আগে বিচারপতি থাকাকালীন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসেই অতিরিক্ত শূন্যপদ প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার কথা উঠে এসেছিল। আর সেটা স্বয়ং শিক্ষাসচিবের মুখে। আদালতে উপস্থিত শিক্ষাসচিব মণীশ জৈনের কাছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানতে চেয়েছিলেন, অতিরিক্ত শূন্যপদ কেন তৈরি করা হল?উত্তরে শিক্ষাসচিব বলেন, উপযুক্ত স্তর থেকেই নির্দেশ দেওয়া হয়। ব্রাত্য বসু নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইনি পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। আইনজীবী ও অ্যাডভোকেট জেনারেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল। আইন দফতরের সঙ্গেও কথা বলি।কথা হয়, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। মুখ্যসচিবকে বিষয়টি জানানো হয়। নোট পাঠানো হয় ক্যাবিনেটে।
কলকাতা হাইকোর্টের সোমবারের রায়েও সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। রায়ের কপির ২১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, বেআইনি নিয়োগের জন্য SSC অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরির আবেদন জানিয়েছিল। রাজ্য সরকারও তার বিরোধিতা করেনি। এমনকী, আদালতে পেশ করা নথিতে দেখা গেছে, বেআইনিভাবে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদের জায়গা করে দিতে, রাজ্যের মন্ত্রিসভা অবধি অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরিতে ছাড়পত্র দিয়েছিল। প্রধান সচিব সিঙ্গল বেঞ্চে হাজির হয়ে, অতিরিক্ত শূন্যপদ তৈরি সংক্রান্ত ক্য়াবিনেট নোট এবং ক্যাবিনেট মেমো পেশ করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে আইনজীবী ও সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, 'পরিচ্ছন্ন প্রশাসনকে কীভাবে ঘুম থেকে ভাঙাতে হয় এবং দুর্নীতিবাজ প্রশাসকদের মুখোশ খুলে দিতে হয়, তার উদাহরণ হচ্ছে আজকের এই রায়। বহু মানুষ তাঁরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনলে কী পরিণতি হতে পারে।'
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, 'যারা অযোগ্য, তাদের বার করে দিয়ে আমরা যে নতুন নিয়োগ দিতে চাই, এটা তো আমরাই, SSC CAN অ্যাপ্লিকেশন করেছিল কোর্টে। অর্থাৎ আমরা যেটা বলেছিলাম, কোর্ট তো সেটাই আজকে মান্যতা দিলেন। কিন্তু, সেই সময়ে বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি আমাদের CAN অ্যাপ্লিকেশন, SSC-র করা CAN অ্যাপ্লিকেশন আপনি যদি বলেন, যে আপনি যদি বলেন, আমরা যারা অযোগ্য আছি, তাদের বাদ দিয়ে, আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া করতে পারি, সেই কথাটায় গুরুত্ব না দিয়ে, সেটার পিছনে CBI দিয়েছিলেন। সেই CBI এখনও স্থগিতাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিয়ে রেখেছে।'
এবার কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে, অতিরিক্ত শূন্যপদ নিয়ে সিবিআই কোন পথে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবে? কোনও বড় মাথাকে কি তারা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদৌ ডাকবে?
আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট এখন পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে