কলকাতা: ময়দানে হরিহর আত্মা বল হয় তাঁদের।


বলা হবে নাই বা কেন? দুজনেরই উত্থান জেলা থেকে। একজন মেদিনীপুর। অন্যজন হাওড়া। বাংলার হয়ে একসঙ্গে বহু ম্যাচ খেলেছেন। জিতিয়েছেন। জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে একসঙ্গে কাটিয়েছেন। আইপিএলেও ছিলেন সহযোদ্ধা। এক ক্লাবের হয়ে স্থানীয় ক্রিকেট খেলেছেন। চাকরি পর্যন্ত করেন একই অফিসে। পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা? তাও একসঙ্গে। কখনও বেরিয়ে পড়ছেন ইউরোপ সফরে, কখনও অন্যত্র। মাঝে একবার দুজনের মধ্যে মতান্তর হয়েছিল বলে শোনা যায়। তবে এখন ফের সুসম্পর্ক। দুজনের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট খুলুন। একে অন্যকে জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, বিবাহবার্ষিকীতে অভিনন্দন দিচ্ছেন। একসঙ্গে ছবি পোস্ট করছেন।


অশোক ডিন্ডা ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার দিন সবচেয়ে আবেগপূর্ণ বার্তাটা দিয়েছিলেন সম্ভবত মনোজ তিওয়ারিই। ট্যুইট করেছিলেন, ‘অবিশ্বাস্য কেরিয়ারের জন্য অভিনন্দন। বাংলার সর্বকালের অন্যতম সেরা পেসার। যে যোগ্য মর্যাদা পায়নি।’


অথচ বুধবারের পর থেকে রাজনীতির ময়দানে তাঁরা প্রতিপক্ষ। কারণ, মনোজ তিওয়ারি যোগ দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসে। অশোক ডিন্ডা বিজেপিতে। একই দিনে। একজন পতাকা তুলে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে। অন্যজন বাবুল সুপ্রিয়র উপস্থিতিতে, শুভেন্দু অধিকারীর কাছে।


ক্রিকেটের বাইশ গজে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। রাজনীতির ময়দানে তো ডিন্ডার সঙ্গে সম্মুখসমর, সামলাবেন কীভাবে? এবিপি আনন্দকে মনোজ বলছেন, ‘ডিন্ডা ওর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে বিষয়ে কিছু বলব না। ডিন্ডাকে সম্মান করি। তবে যেরকম বল করবে সেরকম শট খেলব। ওর ক্যাপ্টেন কিন্তু আমিই ছিলাম। জানি ওকে কীভাবে সামলাতে হয়।’ যা শুনে হাসছেন ডিন্ডা। বলছেন, ‘কত ব্যাটসম্যান তো বলল আমার বল বোঝে। তারপরও উইকেট নিয়েছি। মাঠের জীবনটা আলাদা। রাজনীতির লড়াই আলাদা।’



তাহলে কি বন্ধুত্বে ফাটল? বাড়বে দূরত্ব? প্রশ্ন শেষ করার আগেই মনোজ বলছেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ আলাদা। তবে কোনওদিন ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারব না।’ ডিন্ডার গলাতেও একই সুর। বলছেন, ‘মনোজ ও আমি বাংলার জন্য সব সময়ই মরিয়া। জীবনের সব কিছু ক্রিকেটকে দিয়েছি। দুজনই হয়তো বাংলাকে নিয়েই ভাবছি। রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা। মনোজের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোনওদিনই খারাপ হবে না। জীবনের অর্ধেক সময় একই ড্রেসিংরুমে কাটিয়েছি, টিমহোটেলে রুম শেয়ার করেছি। মনোমালিন্যের জায়গাই নেই।’


ক্রিকেটের বাইশ গজ ছেড়ে রাজনীতির ময়দানে নামার সিদ্ধান্ত কেন? মনোজ বলছেন, ‘সত্যি বলতে কী, জাতীয় দলে নিজেকে আর দেখছি না। পারফরম্যান্স করার পরেও ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছিলাম। আর সুযোগ পাইনি। হাঁটুর চোটের জন্য এই মরসুমে আর খেলতে পারব না। এরই মধ্যে দিদি বললেন, তোকে লড়তে হবে। না করতে পারিনি। তার আগে বিজেপির প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তবে দিদির ডাক ফেরাতে পারিনি। অগ্নিকন্যা বলা হয় দিদিকে। একজন মহিলা সকলের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। উনি অনুপ্রেরণা।’ মনোজ যোগ করলেন, ‘আমার পদবি তিওয়ারি হলেও আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। জন্ম-কর্ম সব এখানে। বিজেপি যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার চেষ্টা করে তা মন থেকে মানতে পারি না। আমার প্রচুর মুসলিম বন্ধু রয়েছে। ধর্মকে নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের সঙ্গে কেন যাব? অনেকেই তৃণমূলে থেকে ভোগ করার পর এখন বিজেপিতে চলে গিয়েছে। এবারের ভোটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। হোক। ম্যাচ হাড্ডাহাড্ডি হলে জেতার তৃপ্তিই আলাদা। অনেকে আমাদের আন্ডারডগ বলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর লেখালিখি হচ্ছে। সেখান থেকে ম্যাচ জিতব আমরাই। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই।’




তাহলে কি ক্রিকেট ছেড়ে দিচ্ছেন? মনোজের জবাব, ‘অবসরের কথা ভাবলে নিয়েই ফেলতাম। তবে খেলা ছাড়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নিইনি এখনও। জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে বাংলার ক্রিকেট সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছি। এখনও মানুষের পাশেই থাকতে চাই।’


ডিন্ডা অবশ্য সদ্য ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। বলছেন, ‘রাজনীতিতে আসার কথা কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে বরাবরই ভালবাসি। সেই কাজের জন্য আদর্শ মঞ্চ হল রাজনীতি। তৃণমূল থেকেও যোগ দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। তবে মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র শুভেন্দু অধিকারীর ডাকে সাড়া দিলাম। মানুষের পাশে কীভাবে দাঁড়াতে হয়, ওঁকে দেখে শিখেছি। মোদিজি দারুণ কাজ করছেন। অমিত শাহজি বাংলাকে উন্নয়নের রাস্তায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করছেন। ওঁদের দলে যোগ দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে।’


বল হাতে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ত্রাস ছিলেন। এবার কি রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রতিপক্ষের উদ্দেশে ঝাঁঝাল শব্দবাণ প্রয়োগ করতে দেখা যাবে? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৪২০ উইকেটের মালিক ডিন্ডা বলছেন, ‘মঞ্চে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য কথা বলব। কোনও ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে রাজনীতির ময়দানে আসিনি। দেখব যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। দিনের ১৪ ঘণ্টা দলকে দেব। যে দায়িত্ব দেবে, পালন করব।’ একই কথা বলছেন মনোজ। বুধবার ভাষণ দেওয়ার পর গলা ভেঙেছে। ধরা গলায় বললেন, ‘ব্যক্তি আক্রমণ নয়, মানুষের উন্নয়নই আমার একমাত্র লক্ষ্য।’


ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হতো। আর এখন গভীর রাত পর্যন্ত রাজনৈতিক বৈঠক চলছে। বুধবারই অনেক রাত পর্যন্ত রাজনৈতিক বৈঠক সারতে হয়েছে ডিন্ডাকে। বাংলার প্রাক্তন পেসার বলছেন, ‘যারা এখন ক্রীড়া দফতর সামলাচ্ছে, তারা খেলার এ বি সি ডি বোঝে না। খেলার লোককেই দায়িত্ব দিতে হবে। মানুষের আশীর্বাদেই মেদিনীপুরের ওই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি। মানুষের পাশে থাকি।’ মনোজের উদ্দেশে বলছেন, ‘ও ভাল কাজ করুক। মানুষের পাশে থাকুক। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিক ও। মনোজ একটা পক্ষ থেকে দাঁড়াচ্ছে, আমি একটা পক্ষ থেকে। দুজনই মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।’