খুব সকালেই ফোনটা এসেছিল।
‘‘আজই বান্দ্রায় আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসো। ‘দঙ্গল’য়ের স্ক্রিপ্ট শোনাব তোমায়।’’
চমকে গিয়েছিলাম আমিরের ফোন পেয়ে। তখন ‘জগ্গা জাসুস’য়ের কাজ নিয়ে রাতের পর রাত জাগছি। এতটাই প্রেশারে যে খাওয়ার কথাও ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু আমির খানের ডাক!
পৌঁছে গেলাম আমিরের বেলা ভিস্টা অ্যাপার্টমেন্টে।
সাদা দাড়ি, সাদা শার্ট, চুল ছোট ছোট করে কাটা এক মাসলম্যান! কোথায় সেই আমির? এ আমির তো ২৫ কিলো ওজন তুলছেন। কোথায় ‘থ্রি ইডিয়টস’য়ের ‘র্যাঞ্চো’? বা ‘ধুম থ্রি’র ‘সমর’? চোখের সামনে সত্যি এক ন্যাশনাল লেভেল রেসলারকে দেখতে পাচ্ছিলাম সে দিন। হলিউড ফিটনেস স্পেশালিস্টদের পরামর্শে আমির তখন পাক্কা ৫০ বছরের মহাবীর সিংহ ফোগত!
শুরু হল স্ক্রিপ্ট রিডিং।
কুস্তিগিরের কাহিনি থেকে জীবনের কথা। আমিরের চোখে দেখেছিলাম সেরা কিছু সৃষ্টির আত্মবিশ্বাস।
আমির বুঝিয়ে দিল এ ছবির মিউজিকের দায়িত্ব আমার। বুঝতেই পারছিলাম একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করাচ্ছে ও। ছবিতে কোথাও রোম্যান্টিক গান নেই! নায়ক-নায়িকা বরফের পাহাড়ে বা সুইৎজারল্যান্ডের রাস্তায় হিট গান গাইবে, তাও হবে না!
বাঁধতে হবে হরিয়ানভির মেঠো গানের সুর।
এই ছবির সুর বান্দ্রায় আমিরের বাড়িতে বা আমার স্টুডিয়োয় বসে যে তৈরি করা যাবে না সেটা খুব ভাল বুঝতে পেরে ছিলাম। আমিরকে সেটা জানাতেই ও তখন বলল ‘‘পঞ্চগনিতে আমার বাংলোয় চলো।’’ সাধে ইন্ডাস্ট্রিতে ওকে ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ বলা হয়? ছবির গান তৈরির জন্য ও এতটা সময় দিয়েছিল ।
ঠিক হল প্রথমে পাঁচ দিনের জন্য শহরের আওয়াজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে আমরা পঞ্চগনিতে একসঙ্গে থাকব। ওখানেই গান তৈরি হবে। আমি, অমিতাভ (ভট্টাচার্য), আমির, পরিচালক নীতেশ তিওয়ারি আর ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট।
পঞ্চগনি খুব শান্তির জায়গা। আমিরের বাংলোটাও চমৎকার। সামনে পাহাড়। শান্ত নদী। সুর যেন আপনা থেকেই বেরিয়ে আসে। আমির যতই কাজ করুক, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যই ওর এই বাংলো কেনা।
জীবন হোক বা সিনেমা, আমির মানুষটাই খুব মেথডিকাল। সেটা ওর সঙ্গে থেকে, ওকে কাছ থেকে দেখে বুঝেছি। ওর কোনও তাড়া নেই। ‘দঙ্গল’য়ের মতো একটা ছবি দু’বছর ধরে করছে ! একই লোক ৫০ বছরের চার মেয়ের বাবা মহাবীর ফোগতের চরিত্র করছে, আবার ১৮ বছরের তরতাজা মহাবীরের অভিনয়ও করছে! ভাবা যায়? এই তো সে দিন ‘দঙ্গল’য়ের সিটিংয়ে দেখলাম কী অসম্ভব রোগা হয়েছে! বলল, ‘‘২০ কেজি কমাতে হয়েছে। এখন মহাবীর সিংহের জীবন ছাড়া আমার চারপাশে আর কিছু নেই, ফিঙ্গারস ক্রসড। লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট। আই অ্যাম ট্রাইং মাই বেস্ট।’’
তাই বলে আমির কিন্তু সারাক্ষণ নিজের ছবির কথা বলছে বা আমাদের মিউজিকের সময় রেসলারদের গল্প বলছে তা নয়। ও জীবনটাকেও দারুণ এনজয় করতে পারে। ওর বাংলোতে সারাদিন ধরে আমি আর অমিতাভ ‘দঙ্গল’য়ের গান তৈরি করতাম। হরিয়ানার মেঠো সুরের সঙ্গে আজকের সাউন্ডস্কেপের মিলমিশ চলত। গান তৈরির সময় আমি আর অমিতাভ দু’-তিনটে অপশন রাখতাম। আমির গানগুলো শুনত। যেটা পছন্দ হত না সেটা সোজাসুজি না বলে দিত। আবার কোনও টিউন এক বারে মনে ধরে গেলে খুব খুশি হত। ‘দঙ্গল’-য়ের সাতটা গান পঞ্চগনিতেই তৈরি হয়েছে। আমরা গিটার আর ঢোল নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা বাজিয়ে ওকে আর পরিচালককে গান শোনাতাম।
রাত্তিরটা ছিল আরও জমজমাট। যে গানগুলো ফাইনালাইজ হয়ে যেত সেগুলো আমরা আবার গাইতাম। আর তার পরেই শুরু হত আমিরের আড্ডা। ও গল্পের খনি। ‘আন্দাজ আপনা আপনা’র মেকিং-য়ের গল্প, ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর শ্যুট-য়ের গল্প। হাসি-হাট্টা। তিন-চার ঘণ্টা পেরিয়ে যেত। ‘ক্লিফ’এর ধারে কাটানো ওই রাতগুলোর কথা কোনও দিন ভুলব না।
আমরা হয়তো যে যার কাজে ব্যস্ত, হঠাৎ আমাদের সবাইকে ডেকে একটা দারুণ ডকুমেন্টারি দেখাল। ‘সার্চিং ফর সুগার ম্যান’, কী অসাধারণ একটা ডকুমেন্টারি। সেটা দেখার পরেই ফিল্ম নিয়ে আড্ডা শুরু হল। আড্ডা এতটাই জমে গেল যে আমরা ভুলেই গেলাম ‘দঙ্গল’য়ের কথা। আমির ওর বই পড়া, ভাল মিউজিক শোনার অভি়জ্ঞতা শেয়ার করতে লাগল। আসলে এক জন বুদ্ধিদীপ্ত লোকের সঙ্গে ছ’টা দিন কাটানোর অভিজ্ঞতাটাই আলাদা। নীতেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট একটা মরাঠি ছবি করেছে। আমিরকে অনুরোধ করতেই ও সেটা পুরো দেখল। তারপর কোথায় কী ভুল আছে পরিষ্কার জানাল। বরাবর সোজা কথা সোজা ভাবে বলতেই দেখেছি ওকে।
আমির তখন রীতিমতো ‘পালোয়ান’। পঞ্চগনিতেও রোজ নিয়ম করে ট্রেনারের সঙ্গে এক্সারসাইজ চালিয়ে যাচ্ছে। ডায়েটের ব্যাপার ছিল না। রোজই আমরা বাড়ির তৈরি খাবার খেতাম। সমস্ত ন্যাচারাল প্রোডাক্ট। স্বাদই আলাদা! আমি আর অমিতাভ দুই পেটুক বাঙালি এমন খেতে শুরু করেছিলাম যে আমাদের দু’জনের ফুড পয়জনিং হয়ে গিয়েছিল। এর পর পঞ্চগনিতে ডাক্তার ডেকে, ওযুধের ব্যবস্থা করে আমির যে ভাবে আমাদের যত্ন করেছিল তা সত্যিই অবিশ্বাস্য! বুঝেছিলাম আসলে এত বড় হয়েও মানুষটা খুব সহজ।
চ্যালেঞ্জ নিতে খুব ভালবাসে আমির। কোনও সুপারস্টার নয়, ‘দঙ্গল’-এ মহাবীরের স্ত্রী-য়ের চরিত্র করছেন যেমন সাক্ষী তানোয়ার। তেমন ফতিমা শানা শেখ এবং সানিয়া মালহোত্র-র মতো নতুন মুখ আছে ছবিতে। একবার কথায় কথায় পঞ্চগনিতেই ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি আগে বেশি বয়সের মহাবীরের অভিনয় করলে, পরে আবার ওজন কমিয়ে অল্প বয়সের মহাবীরের অভিনয় করলে কেন? আমির বলেছিল ‘‘‘দঙ্গল’-এর ছবি শেষ করার পর যদি আমার পঁচানব্বই কেজি ওজন থাকে সেটা ভাল? নাকি আগে পঁচানব্বই কেজি ওজনের অভিনয় করে তারপর চার-পাঁচ মাসে কুড়ি কেজি কমানো ভাল!’’ ছবির জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে এমন অভিনেতা খুব কমই দেখেছি। এখন তো দু’মাসেও চাইলে কুড়ি কেজি ওজন কমানো যায়। আমির কিন্তু সেটা করেনি। ওই যে বলেছিলাম ও আসলে সব বিষয়েই পারফেক্ট।
‘দঙ্গল’-এর জন্য আমির কৃপাশঙ্কর পটেলের মতো জাতীয় স্তরের রেসলার-কে যোগাযোগ করে। আমির বলেছিল, ‘‘‘দঙ্গল’ যেহেতু রেসলিং প্রমোট করবে তাই সবার আগে আমি কৃপাশঙ্কর পটেলের অনুমতি নিয়েছিলাম। আমি কৃতজ্ঞ, উনি আমাকে, আমার অন স্ক্রিন মেয়েদের এই ছবির জন্য টানা এক বছর ধরে রেসলিং শিখিয়েছিলেন।’’
আমিরের কাছে ওঁর একেকটা ছবি এক-একটা জার্নির মতো। চারটে ফিল্মের টাকা একটা ফিল্ম করে তুলে নেয়। সারাক্ষণ কাজ-কাজ করে না ও। বা শুধু এনটারটেনমেন্ট নিয়ে পাগলামি করে না।
আমাকে বলত— ‘‘টাকা কামিয়ে যদি নিজে সেটা খরচা করতে না পারি তো কী লাভ!’’
আমির খানের ‘পঞ্চগনি’র বাংলোয় প্রীতম-অমিতাভ
একটা মজার ঘটনা বলি। পঞ্চগনিতে ওর বাংলোয় আমার প্রথম রাত। আমি ভোররাতে শুনি একটা বাচ্চা ছেলে হইসল দিচ্ছে।
অন্যধরনের নোট। হলে গিয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই! একশো বছরের পুরনো কলোনিয়াল বাংলো। কাউকে দেখতে না পেয়ে আমার গা ছমছম করে ওঠে। এ রকম হুইসল জীবনে শুনিনি। পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে যখন আমিরকে বলি, ও প্রচণ্ড হাসতে শুরু করে। তার পরে বলে, এখানে একটা পাখি আছে যার নাম ‘মালাবার ক্রাশ’। পঞ্চগনিতে সবাই ওই পাখিকে ‘হুইসলিং স্কুল বয়’ নামে ডাকে।
শাহরুখ, আমির, সলমন, তিনজনের সঙ্গে কাজ করেছি আমি। কিন্তু আমার আমিরকে অ্যাক্টরের চেয়ে মনে হয় বেশি ডিরেক্টর। টেকনিক্যালি অসম্ভব সাউন্ড। শাহরুখ অসাধারণ অভিনেতা। আর দরাজহৃদয়। সলমনের ছবিতে এন্টারটেনমেন্টই শেষ কথা। ‘সুলতান’ আর ‘দঙ্গল’ নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে ওর মধ্যে এসব নিয়ে কোনও উত্তেজনা এখনও দেখিনি। আমিরের লড়াই ওর নিজের সঙ্গে। নয়তো ‘দঙ্গল’য়ের মতো ছবি দু’বছর ধরে কেউ করে! ও যদি সে রকম কম্পিটিটিভ হত, তা হলে তো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছবিটা রিলিজ করাত।
যে যাই বলুক আমি জানি বছরের সেরা ছবিটা আমির বানিয়ে ফেলল।