কলকাতা: বহুদিনের প্রতীক্ষার পর অবশেষে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে 'ভটভটি' (Bhotbhoti)। তথাগত মুখোপাধ্যায় (Tathagata Mukherjee) পরিচালিত, ঋষভ বসু (Rishav Basu), বিবৃতি চট্টোপাধ্যায় (Bibriti Chatterjee) ও দেবলীনা দত্ত (Debolina Dutta) অভিনীত অন্যধারার এই ছবি দেখে প্রতিক্রিয়া দর্শকদের বেশ আশাব্যঞ্জক। তবে হাজার ব্যস্ততার ফাঁকেও নিজের ছবি, তার দৃশ্যায়ন, কাস্টিং থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, আগামী কাজ নিয়ে খোলামেলা কথা বললেন তথাগত মুখোপাধ্যায়। শুনল এবিপি লাইভ


প্রশ্ন: 'ভটভটি'র কনসেপ্টটা কী করে এল?
তথাগত মুখোপাধ্যায়: আমি মূলত আইডিয়া ভিত্তিক ছবি বানাই। এমন কোনও আইডিয়া, যা দিয়ে আমি দর্শকদের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারি। সেই জিনিসকে অডিও-ভিস্যুয়ালে রূপান্তরিত করাই আমার লক্ষ্য থাকে। 


একটা আইডিয়া মাথায় ছিল। আমার বন্ধু অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়, 'ভটভটি'র সংলাপ ও স্ক্রিনপ্লে লিখেছেন। তো আমরা একদিন রাতে রবীন্দ্র সরোবর লেকে যাই। আর তার আমি কখনও সন্ধ্যার পর লেকে যাইনি। তো সেই নিঝুম রাতে লেকের ধারে বসে আমাদের 'লক নেস মনস্টার' নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তখনই জলপরী, জলের তলার পৃথিবীর আলোচনা হতে হতে 'ভটভটি'র আইডিয়া আসে। 


আমি এমন একটা বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাইছিলাম যা পৃথিবীর সব দেশে প্রাসঙ্গিক। সেরকম দুটো জিনিস হচ্ছে রূপকথা ও বিপ্লব। পৃথিবীর এমন কোনও সভ্যতা নেই যেখানে এই দুটো জিনিস ঘটেনি। আমার মনে হয়েছিল এই দুটো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। কারণ মানুষ নিজের সবচেয়ে আরামদায়ক, ভাল সময়ে রূপকথায় মজতে ভালবাসে। আর মানুষের কাছ থেকে সব কেড়ে নেওয়া হলে সে হাতে বন্দুক তুলে নেয়। দুটোই এক্সট্রিম পরিস্থিতি। আর এই ছবিতে আমি কোথাও রূপকথা ও বিপ্লবকে হাত ধরাধরি করে দৌড় করিয়েছি। 


প্রশ্ন: সিনেমার নাম 'ভটভটি' কেন?
তথাগত: এর কারণ মূলত এটা প্রান্তিক মানুষদের গল্প বলে। গ্রামের মানুষদের অনেক ধরনের ডাকনাম হয় তো! আমাদের ছবির প্রধান চরিত্র জলের তলা থেকে পয়সা কুড়োয়। তো আমি চেয়েছিলাম এমন একটা নাম রাখতে যার সঙ্গে জলের যোগাযোগ আছে। আবার ডাঙার মানুষও তা বলে। সেই থেকেই 'ভটভটি' আসে। এই নামটা ভীষণই স্থানীয় আর কোথাও গিয়ে এই নামটা সেই প্রান্তিক মানুষগুলোর প্রতীক। কারণ 'ভটভটি'তে করে যাঁরা যাতায়াত করে তাঁরা সেই দৈনন্দিন মানুষগুলো।


প্রশ্ন: নিজের তৈরি ছবি নিজের সন্তানের মত হয়। কিন্তু সিনেমার এমন কোনও বিশেষ অংশ আছে যেটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
তথাগত: এই ছবির প্রিয় দৃশ্যের কথা বলতে পারি। যেটা ছবির টিজারেও ছিল। একটা দড়ি টাঙানো, সেখানে বিভিন্ন রঙের জামাকাপড় উড়ছে। এর আগে আমার একটা ছোট ছবিতে খানিক অন্যভাবে এই দৃশ্যটা ছিল। সেটাই এক্ষেত্রেও ছবির প্রিয় শট আমার। এই দৃশ্যটা দিয়ে মনে হয় জীবন প্রতিফলিত হচ্ছে। অংখ্য রঙিন জীবন, যাদের খানিক রং চটে গেছে। সঙ্গে প্রচণ্ড জোরে হাওয়া আর তাতে সেগুলো উড়ছে। আমার মনে হয় ওই শটটা দিয়ে মানব জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায়। অনেকগুলো রং, কোনও বেশি উজ্জ্বল, কোনওটা কম। এছাড়াও অনেক শট পছন্দের। যেমন একটা দৃশ্য আছে যেখানে বিবৃতি ও ঋষভ কাশফুলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ওটাও আমার প্রিয় দৃশ্যগুলোর অন্যতম। তারপর একটা জায়গায় আছে দোলনায় দুলছে আর একপাল ভেড়া নিয়ে যাচ্ছে। এই শটগুলো সমস্ত প্রাথমিক রেকি থেকেই মোবাইলে শ্যুট করে ঠিক করা ছিল। গোটা ছবিটারই একটা আলাদা আনন্দ আছে।


প্রশ্ন: কাস্টিং কী মাথায় রেখে করেছিলেন?
তথাগত: যখন আমি 'ভটভটি' লিখি তখন চোখের সামনে চেনা অভিনেতাদের মুখ ভেসে আসে। যাঁদের প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। তবে তারপর মাথায় আসে তাঁদের দিয়ে হবে কি না। অর্থাৎ, তাঁরা কতটা ডিসিপ্লিনড বা আমার কাজের পদ্ধতির সঙ্গে কতটা মানিয়ে চলতে পারবেন। 


তবে কিছু চরিত্র কোনওদিনই মাথায় আসে না। যেমন ভটভটির মুখ আমার কোনওদিনই মাথায় আসেনি, ফলে নতুন মুখ প্রয়োজন ছিল। এরিয়েল অর্থাৎ বিবৃতি যে চরিত্রটি করেছে, সেখানে প্রথমে ভেবেছিলাম যে ভটভটির থেকে বয়সে বড় কোনও অভিনেত্রীকে দিয়ে করাব। সেই সময়ে কোয়েল মল্লিক, সোহিনী সরকার ও প্রিয়ঙ্কা সরকারের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাঁরা তিনজনেই খুব উৎসাহ নিয়েই রাজি হন। সেটা ২০১৬ সালের কথা। কিন্তু তখন ছবিটার কাজ এগনো যায়নি। তখন তৈরি হলে হয়তো কোনও তথাকথিত পরিচিত অভিনেত্রীকেই দেখা যেত।


অন্যান্য চরিত্রের ক্ষেত্রে আমি লেখার সময়ে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে কার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে তা খুঁজি। সে কোনও নন-অ্যাক্টরও হতে পারেন। কেবল অভিনয় পারবেন কি না দেখে নিই। চেনা মুখেদের অনেক সময় টাইপকাস্ট করে রাখা হয়। তাঁদের কাউকে দেখে যদি মনে হয় তবে একেবারে ভিন্ন চরিত্রে কাস্ট করি। যেমন এই ছবিতে অনির্বান চক্রবর্তী একজন খুনির চরিত্রে রয়েছেন, যিনি খুবই মিষ্টি একটা মানুষ হিসেবে পরিচিত। যখন 'ভটভটি'র শ্যুটিং হয় তখন আর কোনও নেগেটিভ চরিত্র করেননি তিনি। এবং এই চরিত্রের মতো নেগেটিভ এখনও কোথাও করেননি তিনি। তো আমি সবার ক্ষেত্রেই চেষ্টা করেছি যে মুখোশ সরিয়ে আসল মানুষটাকে দেখে কাস্ট করার।


প্রশ্ন: শ্যুটিংয়ের এমন কোনও ঘটনা, যেটা মনে থাকবে অনেকদিন?
তথাগত: যেখানে কাশবনে দৌড়ানোর শ্যুটিংটা হয়েছে, সেখানে রেকি করতে গিয়ে দেখেছিলাম যে জল সেরকম নেই। একটা ছোট্ট নালা মতো বয়ে যাচ্ছিল ব্রিজের নীচ দিয়ে। শ্যুটিং করতে গিয়ে দেখি সেখানে এক হাঁটু জল। এদিকে অভিনেতা অভিনেত্রীরা প্রত্যেকে শ্যুটিংয়ের জন্য পোশাক পরে রেডি। তাদের ওপারে যেতে হবে। বিদ্যুতের তার সেই জলের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, ফলে শেষপর্যন্ত তাঁদের পাঁজাকোলা করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আমাকেও করতে হয়েছিল, কারণ ওই হাঁটুজলেই জলের প্রচণ্ড স্রোত। ফলে শক্তিশালী না হলে সেই পারাপার করাটা সম্ভব ছিল না। ফলে আমার যেহেতু একটু বড়সড় চেহারা তাই আমার ওপরও পারাপার করানোর দায়িত্ব পড়েছিল। (হাসি)। আসলে শ্যুটিংয়ের সময়ে অক্টোবর মাসে তখন বৃষ্টি চলছে। ওই নালাই তখন ভরে যাচ্ছিল। ওই গোটা ঘটনাটা স্মৃতিতে থেকে যাবে।


প্রশ্ন: আপনার, দেবলীনার ও বিবৃতির ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমীকরণ সিনেমায় কোনও প্রভাব ফেলতে পারে, সেই চিন্তা হয়েছিল কখনও? 
তথাগত: না না। সেরকম কখনও মনে হয়নি। সিনেমা আমার যাপনের অঙ্গ হলেও, সেটা সবসময়েই আলাদা একটা জায়গায় থেকেছে। ফলে সিনেমা ও ব্যক্তিগত জীবন কখনও মিশে যাওয়ার ব্যাপারই হয়নি। 


আমি সিনেমা ভালবাসি। আমি চাকরি করার মতো বা শুধু পরিচালক হলাম বলার জন্য সিনেমা আমি বানাই না। আমি বেঁচে থাকার জন্য সিনেমা বানাই। এবং দেবলীনা ও বিবৃতিকে আমি যতটা চিনি তাঁরা অত্যন্ত প্রোফেশনাল। তাঁদের কাছে অভিনয়টা কেরিয়ার আর তার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন ওঁরা মিলিয়ে ফেলে না। প্রমোশনের সময়েও আমাদের কোনও সমস্যা হয়নি। দুজনেই ওঁরা কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সিরিয়াস।


প্রশ্ন: এরপর বিবৃতি আর দেবলীনাকে একই ছবিতে নিয়ে কাজ করবেন?
তথাগত: 'ভটভটি' ও 'গোপনে মদ ছাড়ান'-এর মাঝে একটা ছবি করার কথা ছিল। নাম ছিল 'অবিচুয়ারি: মৃতের জন্য নোটিস'। সেই সিনেমাটায় দেবলীনা ও বিবৃতির একসঙ্গে কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই ছবির কাজ এই মুহূর্তে পিছিয়ে গেছে। তবে নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে দেবলীনা ও বিবৃতির মতো যদি কোনও চরিত্র থাকে তাহলে দু'জনকেই অফার করব। ওঁরা প্রোফেশনাল হিসেবে, যদি চরিত্র পছন্দ করে তাহলে করবে। আবার পছন্দ না হলে করতে না-ই পারে। তাতে আমি কিন্তু রেগে যাই না। কাউকে কাস্ট করাটা যেমন আমার চয়েস, তেমনই সে আমার সঙ্গে কাজ করবে কি না তা তার সিদ্ধান্ত।


অন্যান্য কাজের জন্য 'অবিচুয়ারি'র কাজ আটকে যায়। তবে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই সেই ছবি হবে। দেবলীনা ও বিবৃতি নিজেরা একসঙ্গে কাজ করবে কি না ওঁদের সিদ্ধান্ত তবে আমি চরিত্রের প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই কাস্ট করব। সিনেমার প্রতি ওইটুকু সততা না থাকলে আমি সিনেমা বানানো ছেড়ে দেব। কারও ওপর ব্যক্তিগত রাগ আছে বলে তাকে প্রয়োজন পড়লেও সিনেমায় কাস্ট করছি না, সেটা আমার ছবির ক্ষেত্রে হবে না।


আরও পড়ুন: Byomkesh Hatyamancha: এবার বিদেশে ব্যোমকেশ, অরিন্দমের 'হত্যামঞ্চ' মুক্তি পাচ্ছে আন্তর্জাতিক স্তরে


প্রশ্ন: আগামী কী কাজ আসছে?
তথাগত: করোনার জন্য বেশ কিছু কাজ আটকে ছিল। দুটো ছবি তৈরি হয়ে রয়েছে। ২০১৯-এ আমি 'ভটভটি' তৈরি করেছিলাম, ২০২০-এর শুরুতে বাকিটা শ্যুট করি। এছাড়া একটা হিন্দি ছবি রয়েছে, 'মেমরি এক্স'। বিনয় পাঠক, বিক্রম চট্টোপাধ্যায় ও স্মৃতি কালরা অভিনীত। শীঘ্রই কোনও জাতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাবে। সময় ও স্পেস নিয়ে একটা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার এটি। এবং অবশ্যই নাম শুনে বুঝতে পারছেন, স্মৃতি নিয়ে একটা বড়সড় ব্যাপার রয়েছে। 


এটা ছাড়া আসছে 'গোপনে মদ ছাড়ান'। সিঙ্গল শট সিনেমা। ১১ জন অভিনয় করেছেন। দু'ঘণ্টার ছবি একটা টানা শটে তৈরি হয়েছে। দৌড়াদৌড়ি, মারপিট, গোলাগুলি, গাড়িতে চড়ে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যাওয়া সবটাই টানা একটা শটে।


এছাড়া একটা ছবির কথা চলছে। স্ক্রিপ্ট হয়ে গেছে। সেটা ডিসটোপিয়ান পৃথিবী হরর মুভি। ভূতের নয়, সেখানকার ভয়াবহতা নিয়ে। 'ভটভটি'র মুক্তি পেয়ে গেছে। এবার এই ছবির কাস্টিং সেরে হয়তো এই বছরের শেষে বা সামনের বছরের শুরুতে শ্যুটিং শুরু করব। এটিও একটি হিন্দি ছবি।