কলকাতা: ধামাকা হল, কিন্তু সেই ধামাকার শব্দটা কানে এসে পৌঁছোল কি? অনুভূতিতে ধরা পড়ল কি ধামাকার অনুরণন? ধোঁয়ার কুন্ডলি কি জমাট বেঁধে রইল মনে?


 
নাঃ। তেমন কিছুই হল না। নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘ধামাকা’-র ক্লাইম্যাক্সের শেষে পৌঁছে মনে হল হঠাৎ দেখা তালকাটা বিদঘুটে একটা স্বপ্ন শেষ হল বোধহয়। পরিচালক রাম মাধবানি ২০১৩-য় মুক্তি পাওয়া কোরিয়ান ছবি ‘দ্য টেরর লাইভ’-এর একটা দুর্দান্ত হিন্দি রিমেক বানানোর চেষ্টা করলেন বটে। কিন্তু তাঁর প্রয়াস কতটা সফল হল সেটাই প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে ঝুলে রইল নিউজ চ্যানেল ভরোসা টোয়েন্টি ফোর ইন্টু সেভেন-এর স্টুডিওয়। নিউজ চ্যানেলে ফোন করে একজন বিস্ফোরণে সেতু উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিলেন, বিস্ফোরণও হল...আর সেই খবর পুলিশকে না জানিয়েই খবর টেলিকাস্টের সিদ্ধান্ত নিলেন একজন অ্যাঙ্কর, এক্সক্লুসিভ-এর লোভে! বিশ্বাস যোগ্য?


ছবির কাহিনি বোনা হয়েছে একটি টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলের স্টুডিওকে ঘিরে। লাইভ খবর, সেই খবরের কেন্দ্রে একজন মানুষ, রঘুবীর মহতা। তার হাতে ধরা রয়েছে মুম্বই শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একাধিক বোমার রিমোট। সে প্রতিশোধ চায়। সমাজে খেটে খাওয়া, ছাপোষা সাধারণ মানুষের প্রতীক হয়ে উঠে প্রতিকার চায়। রাজনৈতিক, সামাজিক প্রতারণার মূল্য চায়...অনেকগুলো জীবনের বিনিময়ে। তার ঠিক উল্টোদিকে রয়েছেন একজন টেলিভিশন অ্যাঙ্কর। সেই অ্যাঙ্করের মাধ্যমেই খবরে থেকে, খবর হতে চায় সেই মানুষটি। মন্ত্রীকে স্টুডিওয় হাজির করিয়ে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করানোই তাঁর শর্ত। শর্ত না মানলে ফল হবে ভয়াবহ। সেই ভয়ানক ফলের নমুনা দেখাতে গিয়ে কাহিনির গোড়াতেই বান্দ্রা-ওরলি সি-লিঙ্ক বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয় সে। এরপর ধারাবাহিক বিস্ফোরণের হুমকি। তার কথার বেচাল হলেই অ্যাঙ্করেরও প্রাণনাশের সম্ভাবনা, তাঁর কানের ইয়ার-পিসেও তো লুকিয়ে রয়েছে প্রাণঘাতী বোমা!


এরই মাঝে একটা প্রেমের গল্পও রয়েছে। অ্যাঙ্করের চেয়ারে বসে থাকা অর্জুন পাঠক, আর তাঁর স্ত্রী সৌম্যা মেহরা পাঠকের প্রেম কাহিনি। দু’জনেই সংবাদ মাধ্যমের কর্মী। অর্জুন যখন অ্যাঙ্করের চেয়ারে বসে টেলিফোনে রঘুবীর মহতার সঙ্গে কথা বলে চলেছে, তখন বান্দ্রা-ওরলি সি-লিঙ্কের ওপরে লাইভ রিপোর্টিং করছেন তাঁর স্ত্রী সৌম্যা। তাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা শুরু হয়েছে। কিন্তু ভালবাসা? বোঝাই যায় ভালবাসা তখনও অটুট। জীবন বিপন্ন করে সৌম্যা যখন ভেঙে পড়া ব্রিজে ঝুলতে থাকা গাড়ি থেকে একটি ছোট্ট মেয়েকে উদ্ধার করে, তখনও ক্যামেরার সামনে লাইভ অ্যাঙ্করিংয়ের দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে অর্জুনকে। অর্জুনের চরিত্রটিকে পরিচালক যেভাবে গড়েছেন তাতে পেশাদারিত্ব আর অনৈতিক কাজ এক্কেবারে গুলিয়ে গেছে। অর্জুন যা করছেন তা এককথায় অপরাধ, পেশাদারিত্ব নয়। আর তাঁকে যেভাবে কাঠের পুতুলের মত চালনা করার চেষ্টা করছেন তাঁর বস তা সত্যিই হাস্যস্পদ। অর্জুনের বস অঙ্কিতা মুহুর্মুহু যে ভাবে টি-আরপির ওঠা-পড়ার অঙ্ক বোঝাচ্ছেন, সে ভাবে কোনও নিউজ চ্যানেলে টিআরপি মাপা হয় না। বোঝা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়, তিনি টিআরপি-র ওঠা-নামা বোঝাচ্ছেন, নাকি সেনসেক্স! আবার একটি দৃশ্যে দেখা যায় এক টিলিভিশন চ্যানেলের নিউজ অ্যাঙ্কর অন্য এক টেলিভিশন চ্যানেলের নিউজ অ্যাঙ্করকে লাইভে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, তাঁর দুর্নীতি নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন! এমনটা সম্ভব কখনও? ‘ধামাকার’ নড়বড়ে কাহিনি এগোয় এভাবেই। এগোতে এগোতে প্রত্যাশা মতই ক্লাইম্যাক্স আসে। প্রত্যাশিত পথে হেঁটেই কাহিনি শেষ হয়। ধামাকা শেষ হয়। 


টেলিভিশন অ্যাঙ্কর অর্জুন পাঠকের চরিত্রে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন কার্তিক আরিয়ান। তাঁর স্ত্রী সৌম্যা মেহরা পাঠকের ভূমিকায় ম্রুণাল ঠাকুর। অর্জুনের বস অঙ্কিতা মালাসকারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অম্রুতা সুভাষ। কার্তিক আরিয়ান এতদিন যে ধরণের ছবি করে এসেছেন, সেই সব চরিত্র থেকে সরে দাঁড়িয়ে একদম ভিন্ন ভআবে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু গলদটা রয়ে গিয়েছে উচ্চকিত চিত্রনাট্যের মতোই উচ্চকিত অভিনয়ে। তুলনায় ম্রুণাল ঠাকুরের অভিনয় সংযত। ছোট্ট চরিত্র হলেও ম্রুণালের অভিনয় নজর কাড়ে। অম্রুতা সুভাষের চরিত্রটি সারাক্ষণ উচ্চগ্রামে বাঁধা। বিশেষ কিছু করারও নেই। তাই অভিনয়ের দিক থেকেও প্রাপ্তির অঙ্কে ‘ধামাকা’র শব্দ কানে বাজে না। তবে শাহিদ কপূরের সঙ্গে ‘কবীর সিং’-এর পর এই ছবিতেও ছোট্ট চরিত্রে নজর কেড়েছেন সোহম মজুমদার। শ্রমিক রঘুবীর মহতার ছেলে আনন্দ মহতার চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। আর আনন্দের চরিত্রই ‘ধামাকা’-র মাস্টার মাইন্ড। 


কোভিড পরিস্থিতিতে রাম মাধবানী এই ছবির শ্যুটিং শেষ করেছিলেন মাত্র দশ দিনে। হ্যাঁ। মাত্র ১০ দিনে। প্রচুর টেকনিক্যাল সাপোর্ট ব্যবহার করা হয়েছে শ্যুটিংয়ের সময়। শব্দগ্রহণের জন্য ২১ টি মাইক্রোফোন, মূল শ্যুটিংয়ের সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে চলেছে সেকেন্ডারি ফুটেজের শ্যুটিংও। শুধু মাত্র হেলিকপ্টারের দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের জন্য হোটেলে বানানো সিনেমার সেট ছেড়ে বাইরে একটি খোলা জায়গায় বানানো ক্রোমা সেটে যেতে হয়েছিল ইউনিটের সদস্যদের। কিন্তু এই সামান্য কটা দিনে যে তাড়াহুড়োয় তৈরি হল ধামাকা, তার ছাপ ছবির মূল ভাবনা থেকেই ধরা পড়ে।


কল্পনায় লেখা চিত্রনাট্য। বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজতে বসলে যাঁরা টেলিভিশন মিডিয়ায় কাজ করেন, তাঁদের মাথা ব্যথা হবেই। ঠুনকো, হাল্কা কিছু সংলাপ একজন অ্যাঙ্করের মুখে বসিয়ে পরোক্ষে সত্য পরিবেশনের যে দায়িত্ব এই ছবির নির্মাতারা নিতে চেয়েছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। সাধারণ মানুষ ড্রামা পছন্দ করতেই পারেন। কিন্তু তারও একটা মাত্রা থাকে। এই ছবি জুড়ে শুধু মাত্র ড্রামাকেই বাজি রেখে চরম ভুলটা করে ফেলেছেন পরিচালক। খবর পরিবেশনের প্রাথমিক শর্তগুলোই এই ছবিতে অধরা। সিনেমায় খবর যেভাবে এয়ার হচ্ছে, তা সত্যিই হাস্যকর হয়ে ওঠে। এই ছবির কি আদৌ কোনও রিসার্চ-টিম ছিল? গল্পের গরু ধীরে-সুস্থে পাতা চিবোতে চিবোতে গাছে উঠতেই পারে। কিন্তু এ যেন গাছে না উঠে সোজা গিরিপথ বেয়ে পর্বত চুড়োর দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। আর চিত্রনাট্যের ধামাকা নয়, গলায় বাঁধা ঘন্টার টুং-টাং শব্দই শুধু কানে এসেছে। পরিচালক রাম মাধবানী এবং পুনীত শর্মা এই ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন। চিত্রনাট্যের খামতি মেটাতে সঙ্গীত পরিচালক বিশাল খুরানার আবহ সঙ্গীতই যেন ভরসা। ছবির এক্কেবারে শুরুতে ফ্ল্যাশব্যাকে অর্জুন আর সৌম্যার রোম্যান্টিক মুহুর্তগুলো স্বপ্নের মায়াজাল বোনে ঠিকই। কিন্তু কাহিনি এগোতেই ছন্দপতন। বিবাহ বিচ্ছেদের ফাইলে পেন দিয়ে লিখে খবরের নোটস নেওয়াই কি পেশাদারের আকাশচুম্বী উচ্চাকাঙ্খার প্রতীক? ভাবনাটা বড়ই নাটুকে নয় কী? যে প্রেক্ষাপটে, আর যে ডিটেলিংয়ে এই ছবিটি বানানো হয়েছে, তা যেন বুদ্বুদের মধ্যে থাকা ভাসমান একটি ভাবনার প্রতিচ্ছবি। সেই বুদ্বুব ফাটানোর জন্য ধামাকার প্রয়োজন নেই। আলতো ফুঁ-ই যথেষ্ট।