কলকাতা : তরুণ মজুমদার (Tarun Majumdar)। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তাঁর নামটাই যথেষ্ট। পরিচালক তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই একেবারে নির্ভেজাল বাঙালি একান্নবর্তী পরিবারের গল্প। 'দাদার কীর্তি', 'ভালোবাসা ভালোবাসা'। একের পর এক মনে গেঁথে যাওয়া সমস্ত ছবি। যে পরিচালক 'দাদার কীর্তি'তে পুজোর দৃশ্য অমন মনোগ্রাহী করে তুলতে পারেন, তাঁর নিজের ছেলেবেলার পুজো কেমন কেটেছে? তা জানতে মন চায় বৈকি। এবিপি লাইভের সঙ্গে ছোটবেলার দুর্গাপুজোর দিনগুলো কেমন ছিল, সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার


চলতি বছরে ৯০ বছর বয়সে পা দিয়েছেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। টলিউড ইন্ডাস্ট্রির বয়স যত বেশিই হোক না কেন, তাঁর উপস্থিতিতে বাংলা ছবি আজও চির 'তরুণ' হয়ে রয়েছে। নিজের ছেলেবেলার দুর্গাপুজো নিয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিশিষ্ট ছবি পরিচালক তরুণ মজুরমদার যেন কোথাও নিজেই হারিয়ে গেলেন সেই ছেলেবেলার দিনগুলোয়। স্মৃতির পাতা উলটিয়ে বলছিলেন, 'আমার ছোটবেলার পুজো খুবই সাদামাটাভাবে কেটেছে। খুব সহজ সরল ভাবে। আমরা থাকতাম খুব সুন্দর একটা শহরে। সরু একটা নদীর ধারে। সেখানে যেতে গেলে আজকাল পাসপোর্ট লাগে। বাড়ির কাছ দিয়েই বয়ে গিয়েছে নদী। আমাদের জায়গাটা ছিল প্রধাণত মুসলমান প্রধান এলাকায়। আমাদের এলাকায় সবমিলিয়ে পাঁচ-ছটা সার্বজনীন পুজো হত। সার্বজনীন অর্থে সত্যিকারের সার্বজনীন। এখনকার শহরে যেমন চমক লাগানো পুজো থাকে। আলাদা গেট থাকে। একটা গেট সাধারণ মানুষের জন্য। আর একটা গেট ভিআইপিদের জন্য। তেমন নয়। আমাদের পুজোয় যে কেউ আসতে পারতো। সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষ অতিথি কারও মধ্যে কোনও গেট ভাগ করা ভেদাভেদ ছিল না।' 


ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার সময় পর্যন্ত বগুড়াতে (বর্তমানে বাংলাদেশে) ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি পরিচালক তরুণ মজুমদার। সেখানকার স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন। পুজোর চারটে দিন একেবারেই আর পাঁচটা বাচ্চার মতো পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে কেটেছে তাঁর। পাড়ার অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে হইহই করে কেটেছে পুজোর দিনগুলো। তিনি বলছিলেন, 'আমাদের ওখানকার পুজোর বিশেষত্ব ছিল, একটা পুজোয় কলকাতা থেকে বড় বড় গানের ওস্তাদদের নিয়ে আসা হত। বড়ে গোলাম আলি খাঁ, চিন্ময় লাহিড়ীর মতো ওস্তাদরা গান গেয়ে গিয়েছেন। এমন অনেক বড় বড় ওস্তাদদের গান শুনে পুজোর দিনগুলো কাটতো। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকে ওগুলো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আড়ম্বরটা অতো বেশি ছিল না। সাদামাটা হলেও সংস্কৃতির ছোঁয়া থাকত।' যেমনটা দেখা গিয়েছে তাঁর পরিচালিত 'দাদার কীর্তি' ছবিতেও। পুজোর সময়ে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও নাটক, গান, আবৃত্তি প্রভৃতি নিয়ে মেতে থাকত। তাই আজও সেই সমস্ত পুজোর রেশ রয়ে গিয়েছে তরুণ বাবুর মনে।


অষ্টমী, নবমীর পর বিজয়া দশমী। তরুণ মজুমদার বলছিলেন, 'বিজয়ার দিন দুটো দুটো করে নৌকা বেঁধে তাতে প্রতিমাকে তোলা হত। সেই নৌকো শহরের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত যাতায়াত করত। বিজয়া দেখার জন্য নদীর পাড়ে প্রচুর মানুষের ভিড় জমত। মুসলমান প্রধান এলাকা হলেও সেখানে কোনও জাতপাতের বিভেদ ছিল না। প্রতিমা বিসর্জনের পর একে অপরকে মিষ্টিমুখ করিয়ে কোলাকুলি হত।'


ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার পরই পরিবারের সঙ্গে বগুড়া থেকে কলকাতায় চলে আসেন তরুণ মজুমদার। তখন বয়স চোদ্দ কি পনেরো। সালটা ১৯৫৪। বগুড়া থেকে চলে আসার পরবর্তী সময়টা কেটেছে রিফিউজি অবস্থায়। কলকাতায় এসে থাকতে হয়েছে নানা জায়গায়। কখনও দক্ষিণ কলকাতা তো কখনও উত্তর কলকাতা। বেশ কিছু বছর এভাবে দিন কাটানোর পর একটা জায়গায় থিতু হয়ে থাকতে পেরেছেন। তাই কিংবদন্তি পরিচালকের কাছে ছেলেবেলার পুজো বলতেই তাঁর মনে ভেসে ওঠে বগুড়ার দিনগুলো। সেই স্মৃতি আজও তাঁর মনে 'তরুণ' হয়ে রয়েছে।