কলকাতা: সাল ১৯২৩। রিলটা যদি একটু পিছিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে তখনও ধবধবে ধুতি-পাঞ্চাবি পরে এগিয়ে চলছে শহর-নগর-গ্রাম। খাঁটি নারকেল তেল ভর্তি চুলে, ব্যাকব্রাশ। আর নিপাট করে নাকের উপর কালো ফ্রেম, অহরহ। সে ফ্রেমে চোখ রাখলে, দেখা যায় না দুই বঙ্গের মাঝের সীমান্ত। ঠিক এমনই একটা সময় তাঁর আবির্ভাব তিথি। তখনও কেউ জানতো না, একদিন সেই, ভারতীয় ছবিতে তুলবেন প্রশ্ন। দাগ কাঁটবেন সবার মনে। তিনি আর কেউ নন, মৃণাল সেন (Mrinal Sen)।


স্বাধীন নাগরিক করছে কী ?


এবার একটু এগিয়ে যাওয়া যাক, বরং পরে আবার না হয়, ফের পিছনো যাবে। ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম ফ্রেম। 'রাতভোর' মুক্তি পেয়ে গিয়েছে।মাঝে ৬০ এর দশকে 'ভুবন সোম'ও বেশ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু ৭০ সালে পা দিতেই একঝাক প্রশ্ন শহরের অলিগলিতে। কারণ এই সেই বছর, যা কলকাতা ট্রিলোজি নিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় আলোচিত হয়। দেশ ভাগ তো হয়ে গিয়েছে কবেই। স্বাধীন নাগরিক করছে কী ? সামাজিক, রাজনৈতিক এই প্রেক্ষাপটের মাঝেই ফ্রেম ধরলেন মৃণাল সেন। 


'ইন্টারভিউ'


১৯৭১ সালে 'ইন্টারভিউ', ১৯৭২ সালে 'কলকাতা ৭১'এবং 'পদাতিক'। তৎকালীন সমসাময়িক ছবিতে এক প্রেমের কলকাতা ধরা পড়লেও, মৃণাল সেনের ফ্রেমে তখন অস্থির কলকাতা। প্রেক্ষাপট ১। একদিকে 'ইন্টারভিউ' ছবিতে রঞ্জিত মল্লিক এক শিক্ষিত পুরুষ। একটি ছোট প্রেসে তিনি কাজ করেন। এদিকে তাঁদের এক পারিবারিক বন্ধু একটি বিলিতি কোম্পানিতে চাকরি করে। সেখানে রঞ্জিত মল্লিককে কেউ চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইন্টারভিউ যেতে হবে বিলিতি কায়দায় কোর্ট প্যান্ট পরে। অগত্যা তা জোগাড়ের খোঁজে বেরোলেও শেষ অবধি মেলে না তা। বাধ্য হয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরেই ওই ইন্টারভিউ দিতে যান রঞ্জিত মল্লিক। এবং তাঁর চাকরি হয় না।


ঘুম ভাঙে অন্য এক শব্দে


 প্রেক্ষাপট ২। শোষণের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, দারিদ্রতার ইতিহাস নিয়ে কলকাতা ৭১ হল মৃণাল সেনের প্রথম সরাসরি রাজনৈতিক ছবি। মোট ৫ টি ছোট গল্পের কোলাজ এই ছবিটায়। যেখানে ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৭১ সালের একটা দীর্ঘ সময়ের ফ্রেম ধরা পড়েছে। এই ছবির শুরুতেই আগের ছবির ইন্টারভিউ, কনটিউয়েশন। যার নাম 'বিচারালয়।' দ্বিতীয় গল্প মানিক বন্দ্য়োপাধ্যায়ের,' আত্মহত্যার অধিকার।' প্রবোধ কুমার স্যান্যালের লেখা, তৃতীয় গল্প 'অঙ্গার।' চতুর্থ গল্প সমরেশ বসুর লেখা অবলম্বনে, 'এসমাগলার।' পঞম গল্প অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, 'অভিজাতদের পার্টি।' এই সবকটি গল্পকে ধরে রেখেছে এক তরুণ। যুগযুগ ধরে শোষিত মানুষের প্রতিনিধি সে। মৃণালের সেনের মতে, এই ছবি হল ক্রোধের ধারাবাহিক ইতিহাস। যেখানে শহর কলকাতার প্রায়শই ঘুম ভাঙে পাখির আওয়াজে নয়, অন্য এক শব্দে। 


আমাকে টান মারে রাত্রি-জাগা নদী
আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার
আমার ঘুম ভেঙে হঠাৎ খুলে যায়
মধ্যরাত্রির বন্ধ দ্বার।


কোথায় দাঁড়িয়ে মৃণাল সেনের 'কলকাতা' ?


তবে মৃণাল সেনের 'পদাতিক' নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই। কারণ পরিচালকের এই ছবিটি বাঙালির শয়নে স্বপনে। এই ছবিতে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। তবে প্রশ্ন তুলেই যায় মৃণালের সেনের এই তিনটি ছবি আজও। কতটা বদলাল তেইশে এসে মৃণাল সেনের 'কলকাতা' ?


একদিন কেউ এসে বলবে 
তোমার বসবার ঘরে একটা চৌকি পাতবার জায়গা আছে
আমি ঐখানে আমার খাটিয়া এনে শোবো
আমার গাছতলা আর ভাল্লাগে না।


একদিন কেউ এসে বলবে 
তোমার ভাতের থালা থেকে আমি তিন গ্রাস তুলে নেবো
কারণ আমার কোনও থালাই নেই
আমার অনাহার একঘেয়েমির মতন ধিকধিক করে জ্বলছে
আর আমার ভাল্লেগে না।



ঋণ: সুনীল গঙ্গোপাধ্য়ায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, সরকারি ওয়েবসাইট, সাক্ষাৎকার।