নয়াদিল্লি: অনাচারের ইতিকথা ভুলে যায় মানুষ। কিন্তু প্রকৃতি কিছুই ভোলে না, ক্ষমাও করে না। চিরকালের এই প্রবাদ সত্য হয়ে উঠল দেশের রাজধানীতে (Delhi Floods)। বানভাসি দিল্লিতে এই মুহূর্তে রাজপথে উঠে এসেছে যমুনা। আর জল থৈ থৈ চারিদিক স্মরণ করাচ্ছে বিস্মৃত অতীতকেই, যখন শহরের মধ্যিখান পর্যন্ত ব্যাপ্তি ছিল যমুনার। নগরায়ণের ঠেলায় কোণঠাসা হতে হতে খালের আকার ধারণ করলেও, যমুনা তার হৃত অধিকার বুঝে নিতে এসেছে বলেই মনে করছেন দিল্লিবাসী।


একটানা ভারী বৃষ্টি এবং পড়শি রাজ্যের অতিরিক্ত জল, দুইয়ের প্রকোপে এই মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতি দিল্লিতে। নেতা-মন্ত্রীদের বাড়ি ছুয়ে যমুনার জল এগিয়ে ঢুকে পড়েছে লালকেল্লার চৌহদ্দির মধ্যেও। কংক্রিটের রাস্তা, নগরের সব পদচিহ্ন ছাপিয়ে, যতদূর চোখ যায় শুধু ঘোলাটে জলই দৃশ্যমান, যাকে শুধুমাত্র বর্ষার প্রকোপ হিসেবে দেখতে নারাজ সাধারণ মানুষ থেকে ইতিহাসবিদরা। বকেয়া হিসেব বুঝে নিতেই রাজধানীর বুকে যমুনার প্রত্যাবর্তন ঘটল বলে মনে করছেন তাঁরা।


বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৯ শতকের মুঘল আমলের স্মৃতি ফিরে আসছে। সেই সময়কার একাধিক ছবিতে।যমুনার রূপ যেমন ধরা পড়ে, তেমনই ধরা পড়ে তার একদা ভৌগলিক অবস্থানও। সেই বর্ণনা অনুযায়ী, একসময় লালকেল্লার গা ছুঁয়েই বয়ে যেত যমুনার স্বচ্ছ জল। তখনও দূষণ ছুঁতে পারেনি যমুনাকে, কালো হয়ে ওঠেনি তার জল। কিন্তু যমুনার মান রাখেনি মানুষ। তাই যত সময় এগিয়েছে, পাততাড়ি গুটিয়ে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়েছে যমুনা। লালকেল্লার সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে গিয়েছে।



আরও পড়ুন: Ritu Karidhal Srivastava: শুধু গলাবাজি নয়, মেধাতেই দুরমুশ করেছেন পিতৃতন্ত্রকে, ‘রকেট উওম্যান’ রিতু চন্দ্রযান-৩ অভিযানের নেপথ্যনায়িকা


রানা সফভির লেখা ‘শাহজাহনাবাদ: দ্য লিভিং সিটি অফ ওল্ড দিল্লি’ বইয়ে পুরাতন দিল্লির যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে দিল্লি ও যমুনার লতায়-পাতায় জড়ানো সম্পর্কের উল্লেখ রয়েছে। চতুর্থ মুঘল সম্রাট শাহজাহান আগ্রা ফোর্টের বাইরে রজধানীকে আরও বর্ধিত করতে উদ্যোগী হওয়াতেই সুতো কেটে যায় সেই সম্পর্কের। রানা জানিয়েছেন, আগ্রা ফোর্টে লোকধারণের জায়গা ছিল না। তাই রাজধানীর বিস্তৃতিতে মন দেন শাহজাহান।


দিল্লি অথবা লাহৌরের মধ্যে যে কোনও একটি শহর বেছে নেওয়ার উপায় ছিল শাহজাহানের কাছে। যমুন তীরবর্তী দিল্লিকেই শেষ পর্যন্ত মনে ধরে তাঁর। সেই মতো নগরায়ণ শুরু হয়। যমুনা থেকে লালকেল্লায় ওঠার জন্য ‘ওয়াটার গেট’ ‘খিজরি দরওয়াজা’রও নির্মাণ করান শাহজাহান। যমুনা হয়ে ওই দরজা দিয়েই পাকাপাকি ভাবে লালকেল্লায় ঢোকেন তিনি। আবার ১৮৫৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে, যমুনা হয়েই রাজধানী ছাড়েন বাহদুর শাহ জাফর।




বর্তমানে দিল্লির বুকে রিং রোড যেখানে অবস্থিত, সেখান দিয়ে একসময় যমুনা বয়ে যেত বলে বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদরা।  জানা যায়, লালকেল্লা এবং যমুনার মধ্যে একচিলতে বালিয়াড়িও ছিল। তার উপর গড়ে তোলা হয়েছিল সাজানো বাগান। হাতির লড়াই থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো ওই বালিয়াড়ির উপরই। রাজা-বাদশাহরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও ভিড় করতেন তা দেখতে। যমুনার তীরেই দোল এবং দীপাবলি পালিত হতো বছর বছর। ব্যবসা-বাণিজ্যও চলত যমুনার উপর দিয়েই।  ১৯১১ সালে শাহজাহনাবাদের যে মানচিত্র পাওয়া যায়, তাতে লালকেল্লা এবং সেলিমগড় কেল্লার মধ্যিখান দিয়ে যমুনাকে বয়ে যেতে দেখানো হয়েছে (Delhi Yamuna River)।


কিন্তু দিল্লির নকশায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে যায় ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকের হাতে। কলকাতা থেকে যখন দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় ইংরেজরা, শুরুতে শাহজাহনাবাদের উত্তরে রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু যমুনার জলস্তর, বন্যার ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে রাইসিনা হিলের দিকে নজর ঘোরায় তারা। ইংরেজ শাসকের হাতে নগরায়নের গতি আরও জোর পায়। আর তাতেই ক্রমশ গুটিয়ে যেতে থাকে যমুনা। কিন্তু ১৯৭৮ সালের বন্যার সময়ও রিং রোড এবং আশপাশের এলাকা জলে ডুবে গিয়েছিল।


একদিকে নগরায়ণ, অন্য দিকে ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের চলাচল ক্রমশ দিল্লি থেকে দূরে ঠেলে দেয় যমুনাকে। পাল্টে যায় তার গতিপথ। উত্তর অভিমুখে চলা টেকটোনিক প্লেটের জন্যই হিমালয়ের উচ্চতা বেড়েছে যেমন, তেমনই যমুনাও ক্রমশ পূর্ব দিকে সরে গিয়েছে বলে মত পরিবেশবিজ্ঞানীদের। কোথাও কোথাও যমুনার গতিপথে ৩৪ কিলোমিটারের তারতম্য চোখে পড়ে। যে কারণে দিল্লির বুকে কোথাও কোথাও ঘাট আজও রয়ে গেলেও, যমুনা তার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে। কিন্তু এবারের বর্ষণ সেই যমুনাকেই রাজধানী পর্যন্ত টেনে এনেছে। আর তাতেই অতীতের তুলনা উঠে আসছে। যমুনা পুরনো হিসেব বুঝে নিতে ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন সকলে।