নয়াদিল্লি: বয়স ৯০ পেরিয়েছে। গ্রাস করেছে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতাও। তার পরও মধ্যরাতে হুইলচেয়ারে বসে সংসদে হাজির হয়েছিলেন। সেই মনমোহন সিংহ (Manmohan Singh) এবার সংসদ থেকে বিদায় নিলেন। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর রাজ্যসভা থেকে অবসর নিলেন দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। বুধবার রাজ্যসভার মেয়াদ শেষ হল মনমোহনের। তাঁকে বিদায় জানাতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন সকলে। (Manmohan Singh Retires)
১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম বার রাজ্যসভায় প্রবেশ করেন মনমোহন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মনমোহনের অবসর নিয়ে মুখ খোলেন দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। দেশকে পথ দেখানোর জন্য মনমোহনকে ধন্যবাদ জানান তিনি। জানান, দেশগঠনে মনমোহনের অবদান অনেক।
মনমোহনের অবসরে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গেও। তাঁর কথায়, 'সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও, আমার আশা আপনি ধীশক্তি এবং নৈতিক জ্ঞানের কণ্ঠস্বর হয়ে থাকবেন, যতদূর সম্ভব দেশবাসীর সঙ্গে কথা বলবেন। আপনি সুস্থ থাকুন, সুখী থাকুন এবং শান্তিতে থাকুন'।
মনমোহনের রাজনৈতিক জীবন অনেকের কাছেই অনুপ্রেরণা। ১৯৩২ সালে অবিভক্ত ভারতের গাহতে জন্ম মনমোহনের। যে গ্রামে জন্ম মনমোহনের, সেখানে বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিল না, লণ্ঠনের আলোয় পড়াশোনা করতেন মনমোহন। সেখান থেকে কেমব্রিজে পড়তে যান। অক্সফোর্ড ঠেকে ডক্টরেট অর্জন করেন। দেশের প্রথম শিখ অর্থমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত হন।
দেশের অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে মনমোহনের। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর থাকাকালীন দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করার পাশাপাশি প্ল্যানিং কমিশনেও নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালে নরসিং রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন মনমোহন। সেই সময় চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাঁর দূরদৃষ্টির জেরেই সেই সঙ্কট কাটিয়ে বেরিয়ে আসে ভারত।
মুক্ত অর্থনীতি: ১৯৯০-১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রভাব পড়ে ভারতীয় অর্থনীতিতে। তেলের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাসী ভারতীয়রাও সমস্যায় পড়েন। সেই সময় ভারতের GDP ঘাটতি ৮ শতাংশে পৌঁছে যায়। ঋণের দায়ে জর্জরিত অবস্থা। সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ার তলানিতে এসে ঠেকে। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের দ্বারস্থ হয় ভারত। পাশাপাশি, আমদানি শুল্ক কমিয়ে আনা হয়, রফতানি বাড়াতে কমিয়ে আনা হয় দেশের মুদ্রার মূল্যও। মনমোহনের হাত ধরেই উদার অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্যের সূচনা ভারতে। ফলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে। এর ফলেই ভারতের GDP বৃদ্ধি একধাক্কায় ৮-৯ শতাংশে পৌঁছে যায়।
রেকর্ড GDP বৃদ্ধি: ২০০৪ সালে তদানীন্তন UPA সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মনমোহন। ক্ষমতায় এসে পি চিদম্বরমকে অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ২০০৭ সালে ভারতের GDP বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশে পৌঁছয়। পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয় ভারত। গ্রামীণ ভারতের কর্মসংস্থানে মনমোহনই ১০০ দিনের কাজের সূচনা করেন। এতে গ্রামাঞ্চলের মানুষের আয় সুনিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি, তাঁদের জীবনযাপনের মানোন্নয়ন হয়।
বাজার ও মানুষমুখী উন্নয়ন নীতি: স্বর্ণ চতুর্ভুজ সড়ক নেটওয়র্কের রূপকার মনমোহন। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের চারটি প্রধান শহর, দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই এবং চেন্নাইকে সড়কপথে সংযুক্ত করা হয়। জাতীয় সড়কের উন্নয়ন, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সংস্কার করে মনমোহন সরকার। কৃষকদের ঋণমুক্ত করতেও একাধিক পদক্ষেপ করা হয়।
মূল্য সংযোজন কর: ২০০৫ সালে মনমোহন সরকার সেলস কর সরিয়ে মূল্য সংযোজন কর চালু করে। এর ফলে করব্যবস্থার সরলীকরণ ঘটে।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য অভিযান: ২০০৫ সালে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য অভিযানের সূচনা করে মনমোহন সরকার। এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে সহজলভ্য এবং স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান করা হয়। জায়গায় জায়গায় গড়ে তোলা হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র। শিশুদের অপুষ্টি দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার এবং নিরবচ্ছিন্ন পানীয় জল সরবরাহে পদক্ষেপ করে মনমোহন সরকার।
সংরক্ষণ নীতি: AIIMS, IIT, IIM-এর মতো ঐতিহ্যশালী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন মনমোহন। সেই নিয়ে তরজা শুরু হলেও সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত বহাল রাখে।
শিক্ষার অধিকার আইন (RTE): ২০০৯ সালের ২ জুলাই শিক্ষার অধিকার আইন চালু করে মনমোহন সরকার। এই আইনের আওতায় ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষা মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়। নিখরচায়, বাধ্যতামূলক ভাবে চালু করা হয় শিক্ষার অধিকার আইন।
শিক্ষার প্রসার: মনমোহন সরকারের আমলে দেশে আটটি নতুন IIT-র প্রতিষ্ঠা হয়। পূর্বতন অটলবিহারি বাজপেয়ী সরকার যে সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু করেছিল, সেটিকে চালু রাখা হয়, যাতে সাক্ষরতার হার বাড়ানো যায় এবং প্রত্যেক শিশুকে স্কুলে পাঠানো যায়।
জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (NIA): ২০০৮ সালে ২৬/১১ মুম্বই হামলার পর জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার প্রচলন। সন্ত্রাসদমন, নাশকতামূলক কাজকর্ম প্রতিরোধ এবং দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ওই সংস্থার সূচনা হয়।
সন্ত্রাসের মোকাবিলা: মনমোহন সরকার বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধী আইন (UAPA)-এ সংশোধন ঘটায়। জম্মু ও কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাকামী কার্যকলাপ এবং উত্তর-পূর্বে উগ্রপন্থা রুখতে ওই আইন কার্যকর করা হয়।
আধার কার্ড: মনমোহন সরকারের আমলেই আধার কার্ডের সূচনা। জাতীয় নিরাপত্তা এবং ডিজিটাল পরিষেবাকে উন্নততর করে তুলতে ভারতবাসীর বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করে আধারকার্ড তৈরি করা হয়।
তথ্য জানার অধিকার আইন: ২০০৫ সালে তথ্য জানার আইনের সূচনা করে মনমোহন সরকার, যার আওতায় যে কোনও বিষয়ে সরকারকে প্রশ্ন করতে পারেন সাধারণ মানুষ, সরকারি কাজকর্মের পরিসংখ্যান চাইতে পারেন। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তুলতে এবং সরকারি কাজকর্মে স্বচ্ছতা আনতেই এই পদক্ষেপ করা হয়।
জমি অধিগ্রহণ আইন: ২০১৩ সালের অগাস্ট মাসে রাজ্য়সভায় জমি অধিগ্রহণ আইন পাস হয়। এর আওতায়, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমির মালিককে ন্যায্য় ক্ষতিপূরণ, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়।
বিদেশনীতি: মনমোহনের বিদেশনীতি নিয়ে আস্ত বই লিখে ফেলা যায় বলে মত কূটনীতিকদের। শুধুমাত্র সামরিক সহযোগিতা নয়, অন্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সহযোগিতা গড়ে তোলার পন্থা নেন মনমোহন। ২০০৫ সালে তাঁর হাতেই ইন্দো-আমেরিকা নাগরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় পরমাণু জ্বালানি এবং প্রযুক্তির নাগাল পায় ভারত। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি ছাড়াই ২০০৮ সালের ১ অগাস্ট পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে হিসেবে গন্য হয় ভারত।
ইন্দো-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক: মনমোহনের আমলে চিনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চিন ভারতের প্রধান বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেহে রয়েছে। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধের সময় থেকে সিকিমের নাথুলা পাস বন্ধ ছিল। চার দশক পর সেই পাস খুলে যায় মনমোহনের আমলেই। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও চিনের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দিল্লি-বেজিং, কলকাতা-কুনমিং এবং বেঙ্গালুরু-চেংদু দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা গড়ে তোলার নেপথ্য়েও ছিলেন মনমোহন।
পাকিস্তান নীতি: বাজপেয়ী জমানার নীতি বজায় রেখেছিলেন মনমোহন। শান্তি ধরে রাখতে পারস্পরিক সৌজন্য বজায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন মনমোহন।
ইন্দো-জাপান সম্পর্ক: ২০০৬ সালে জাপানের সঙ্গে কৌশলগত আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে তার পর থেকেই জাপানি বিনিয়োগের রমরমা। ভারত মহাসাগরে চিনা আধিপত্য রুখতে জাপানের সঙ্গে যৌথ মহড়ার সূচনাও মনমোহনের হাত ধরেই। কম খরচে ভারতে দ্রুতগামী ট্রেন চালাতেও জাপানের সঙ্গে চুক্তি করেন মনমোহন।
দ্বিতীয় UPA সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিতর্কে জড়ান মনমোহন। তিনি কয়লামন্ত্রী থাকাকালীন সঠিক পদ্ধতিতে টেন্ডার জারি করে বেসরকারি সংস্থার হাতে কয়লা খনিগুলি তুলে দেওয়ায়, সরকারের প্রচুর টাকা ক্ষতি হয় বলে অভিযোগ ওঠে CAG রিপোর্টে। 2G মামলায় সংসদীয় যৌথ কমিটির সামনে হাজিরা দিতে বলা হয় তাঁকে। ২০১৪ সালে বিজেপি জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন মনমোহন। বরাবরই মিতভাষী মনমোহন। তাই নিজের কাজের বড়াই তিনি করতে পারেননি বলে মনে করেমন তাঁর ঘনিষ্ঠরা। মনমোহন নিজেও জানিয়েছিলেন, ইতিহাস তাঁর প্রতি একদিন সদয় হবেই।