কলকাতা: একজন মা চোখের সামনে দেখলে তাঁর ফুটফুটে বাচ্চাটা আস্তে আস্তে নিথর হয়ে গেল! এক নিমেষে তাঁর জীবন অন্ধকার! সব শেষ!
শোকতপ্ত এই মাকে বুকে টেনে নেওয়ার পরিবর্তে তাঁর সামনেই চরম অমানবিক আচরণ করলেন এই মহিলা! একদিকে মায়ের কান্না। অন্যদিকে পরিবারকে কর্তৃপক্ষের শাসানি!
সোমবার আড়াই বছরের ঐত্রি দে-কে মুকুন্দপুর আমরি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অসুস্থ মেয়েকে কাছছাড়া করতে চাননি মা শম্পা দে। কিন্তু সেই তিনিই চোখের সামনে দেখলেন সন্তানের মৃত্যু! আড়াই বছরের সন্তানকে হারিয়ে এক মা তখন শোকে আকুল। আমি সন্তান হারিয়েছি। এর থেকে বড় কষ্ট আছে? কোল খালি হয়ে যাওয়া এক মায়ের এই আর্তনাদে বুক ফেটে যাওয়ার কথা। আমার কিছু নেই। আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই। আমিও মরতে চাই। আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে দিন ডাক্তারবাবু।
প্রাণের চেয়েও প্রিয় মেয়ের এই পরিণতি দেখে একসময় অচৈতন্য হয়ে পড়ে ঐত্রির মা! দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার জোগাড় হয়! যাকে বুধবার হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল, যার হাসি দেখার জন্য মা-বাবা পাগল হয়ে যাচ্ছিল, সেই ঐত্রির নিথর দেখে বারবার শোকে-যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছিল পরিবার! ঐত্রির বাবা সঞ্জয় দে বলেন, রাতে খেলল, কথা বলল, ওদের গাফিলতির জন্যই মরল আমার মেয়ে। শম্পা বলেন, ইঞ্জেকশন দেওয়া থেকে মেয়ের মৃত্যু। অক্সিজেন মাস্ক ছিল না।

যদিও আমরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তাদের তরফে কোনও গাফিলতি নেই! এরপরই মৃত শিশুর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় শুরু হয় আমরির আধিকারিকদের সঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে ইউনিট হেড জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায় বলেন, আগে নেগলিজেন্স প্রমাণ হোক। বাচ্চার মা ডক্টর নন। এখানেই থেমে থাকেননি জয়ন্তী। বলেন, আমার সঙ্গে মাস্তানি করবেন না। আমি সবচেয়ে বড় মাস্তান।
প্রাণ বাঁচিয়ে লোকের মুখে হাসি ফোটানোর কথা যাদের, তাঁদের কাছ থেকে কি এরকম আচরণ আশা করা যায়? মুকুন্দপুর আমরির শীর্ষ কর্তার এই আচরণ মৃত শিশুর পরিবারের যন্ত্রণাকে ক্ষোভে পরিণত করে।
এতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন পরিবার-পরিজনরা। ঐত্রির মা বলেন, উনি তো মস্তান। মস্তানগিরি করে বাচ্চাটাকে ফেরত দিন। ওই ভদ্রমহিলাকে বলুন, আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে। আমি জিভ দিয়ে ওনার পা পরিষ্কার করে দেব।

অন্য এক আধিকারিক পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হয়নি। হাসপাতালের এক আধিকারিক বলেন, উনি যদি বলে থাকেন, তাহলে অন্যায় করেছেন। শিশুর পরিবারের এক সদস্য পাল্টা বলেন, (জয়ন্তীকে) ডেকে নিয়ে আসুন। এখানে কথা হবে। আপনি ওই ভদ্রমহিলাকে ডেকে নিয়ে আসুন।
মৃত শিশুর পরিবারের সদস্যরা জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলে তাঁদের বাধা দেন নিরাপত্তারক্ষীরা। মৃত শিশুর মা বলেন, উনি এসি রুমে বসে আছেন। আমার মেয়ে এসি রুমে থাকতে পারল না। উনি কি সন্তান হারিয়েছেন? কল হার রাইট নাও।

মৃত শিশুর পরিবারের সঙ্গে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অন্যান্য রোগীর আত্মীয়রাও। একসুরে দাবি করেন, জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়কে ক্ষমা চাইতে হবে। শেষমেশ পরিস্থিতি দেখে বেরিয়ে আসেন আমরির গ্রুপ সিইও রূপক বড়ুয়া। উপস্থিত আত্মীয়রা সকলেই দাবি করেন, ক্ষমা চাইতে হবে ওই ইউনিট হেডকে। তাঁদের প্রশ্ন, ওনার অসুবিধা কী ক্ষমা চাইতে? সিইও রূপক বড়ুয়া আশ্বাস দেন, উনি নিশ্চয় চাইবেন।
রোগীর আত্মীয়দের ক্ষোভের মুখে শেষমেশ ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন মুকুন্দপুর আমরির ইউনিট হেড জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু, তখনও তাঁর মুখে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা। তাঁর দাবি, তাঁকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে। বলেন, আমার গায়ে হাত তুলেছে। হাত মুচড়ে দিয়েছে।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল আমরি কর্তৃপক্ষও তাঁদের আধিকারিকের পাশেই দাঁড়িয়েছে। প্রেস বিবৃতিতে তারাও দাবি করেছে, তাঁরা (মৃতের পরিবার) মহিলা ইউনিট হেডের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। পাল্টা আত্মরক্ষার্থে প্রতিবাদ জানান ইউনিট হেড। পরিস্থিতি শান্ত করতে ইউনিট হেড নিঃশর্ত ক্ষমাও চান। কিন্তু, তা সত্ত্বেও রোগীর পরিবার বিক্ষোভ চালিয়ে যায় এবং ইউনিট হেড ও হাসপাতালের সিইওকে ধাক্কা দেয়। মহিলা ইউনিট হেডকে শারীরিক নিগ্রহ করায় এবং হাসপাতাল চত্বরে ভাঙচুরের চেষ্টার জন্য স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে এবিপি আনন্দকে আমরির গ্রুপ সিইও জানান, জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়কে ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে।

যদিও, বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে সেই সময়ের গোটা ছবি রয়েছে যখন মৃতের পরিবারের সঙ্গে জয়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছিল। সেখানে কিন্তু তাঁকে ধাক্কা মারা কিংবা হাত মুচড়ে দেওয়ার মতো কিছু চোখে পড়েনি। তাই সাফাই দিতে আসা মুকুন্দপুর আমরির ইউনিট হেডের এই আচরণে ক্ষোভে ফেটে পড়ে মৃতের পরিবার। বলেন, আমরা কোনও ডাক্তারের গায়ে হাত তুলিনি, ওনার হাত মুচড়ে দেব কেন? ছ’টা থেকে কিছু করলাম না, আর উনি বলছেন ওনার থেকে বড় গুণ্ডা নেই!

শেষমেশ চাপের মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হন আমরির ইউনিট হেড। যদিও, নিতান্ত দায়সারাভাবে। বলেন, আমি বলতে পারি না। ক্ষমা চাইছি। পরিবারের দাবিতে কান ধরেও ক্ষমা চান জয়ন্তী। তবে, একমাত্র মেয়ের মৃত্যুতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা করতে নারাজ শম্পাদেবী। মেয়ের নিথর দেহ কোলে নিয়ে তাঁর প্রতীজ্ঞা, আমি ততদিন মরব না, যতদিন না আমরি হাসপাতালের শাস্তি হবে।
তবে সত্যি একটাই। আর কোনওদিন হাসবে না ঐত্রি।