রাজীব ঘোষ
ব্যাটে মেদবহুল রান নেই।
বলে শিকারি নেকড়ের কামড় নেই।
দল বাছাইয়েও যুক্তির ছাপ নেই।
সাফল্য আসবে কোন পথে?
এ তো আর গৌতম গম্ভীরদের টিম মালিকের সিনেমা নয় যে, লাস্যময়ী নায়িকা, আইটেম নাম্বার, মনমাতানো গান ছাড়াই ছবি সুপারহিট করিয়ে দেবেন।
এ হল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। ‘এন্টারটেইনমেন্ট কা বাপ’। এখানে ঝোড়ো ব্যাটিং আর বিধ্বংসী বোলিং ছাড়া জয় পাওয়া ‘মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন ভি হ্যায়’।
বৃহস্পতিবার রাতে তা-ই হল। নাইটদের ব্যাট-বল কোনও অস্ত্রেই ধার নেই। অথচ মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ঘরে বারুদ ঠাসা। সেই বারুদের বিস্ফোরণেই যেন এ দিন ওয়াংখেড়ে থেকে নাইটদের আরব সাগরে ছুড়ে ফেলে দিলেন রোহিত শর্মা, কায়রন পোলার্ডরা।
আরব সাগরের পারে বিনোদনের প্যাকেজ দিতে না পারা মানে তা কড়া সাজা পাওয়ার মতোই অপরাধ।
ওয়াংখেড়ের বৃহস্পতি সন্ধ্যায় সেই অপরাধেরই সাজা পেতে হল নাইটদের।
গম্ভীরদের গলায় আটকে থাকা ওয়াংখেড়ে-কাঁটা রয়েই গেল। পাঁচ বছর আগে ভারতের বিশ্বজয়ের মঞ্চকে এত দিন পয়া ভাবতেন গৌতম গম্ভীর। এখন কি আর তা ভাববেন? এই মাঠে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে হাফ ডজন যুদ্ধের পাঁচটাতেই যে হেরে বসল তাঁর দল। সব মিলিয়ে রেকর্ডটা মুম্বইয়ের পক্ষে দাঁড়াল ১৩-৫। সৌজন্যে কায়রন পোলার্ডের হাফ ডজন ছক্কা। ১৭ বলে ৫১। সঙ্গে রোহিত শর্মার ৪৯ বলে ৬৮।
রাজাগোপাল সতীশের এক ওভারে ২৩ আর জয়দেব উনাদকটের এক ওভারে ২২ রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বুঝিয়ে দিল তাদের পাড়ায় তারাই সিংহ।
আগের দিন গম্ভীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ইডেনের ম্যাচটা দেখে ভাববেন না আমরা আর ওদের হারাতে পারব না।” আর গত চারবারের আইপিএল খেতাব ভাগ করে নেওয়া দু’দলের যুদ্ধের পর এ দিন তাঁকে বলতে শোনা গেল, “কোনও অজুহাত দেব না। পোলার্ডের মতো একটা ইনিংস আমাদের কেউ পেলে হয়তো জিততাম। সে আর হল কই?” দুই সংলাপের কন্ঠস্বরে অবধারিত ভাবে বিস্তর ফারাক।
নরিমান পয়েন্টে তাঁদের টিম হোটেলের সামনে মেরিন লাইন্সের মসৃণ রাস্তার সঙ্গে ওয়াংখেড়ের উইকেটে তেমন কোনও তফাত খুঁজে পাননি গৌতম গম্ভীর, জাক কালিসরা। কিন্তু ব্যাটিং উইকেটে কেন এক জন বাড়তি ব্যাটসম্যান খেলানো হল, তা বোধগম্য হল না। লিনের দলে আসা মানে এক জন বিদেশিকে বসতে হত আর কোপটা পড়ল মর্নি মর্কেলের উপর। যাঁর গতি আর বাউন্স কিন্তু ওয়াংখেড়ের উইকেটে ঝামেলায় ফেললেও ফেলতে পারত মুম্বই ব্যাটসম্যানদের। তাঁর জায়গায় এলেন কি না উনাদকাট! বসতে হল পীযূষ চাওলাকেও। মুম্বই মিডল অর্ডারে দু’জন বিদেশি পাওয়ার হিটার (বাটলার, পোলার্ড) থাকা সত্ত্বেও রাখা হল না একজন রিস্ট স্পিনারকে। এ দিন পরে বল করতে হলেও কেকেআর বোলারদের মধ্যে সফল কিন্তু দুই স্পিনারই— সাকিব এবং নারিন। তিন নম্বর স্পিনার থাকলে লড়াই কি আর একটু জমত না? বিশেষ করে সে যখন একজন লেগ স্পিনার।
উনাদকাট কি গত কাল রাতেও জানতেন তাঁকে খেলানো হবে? নাইট পেসারকে যে বুধবার মাঝরাতেও মেরিন ড্রাইভে সতীর্থ অঙ্কিত রাজপুতের সঙ্গে সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল!
দলে যতই খোলা হাওয়া থাকুক, আগের রাতে তাঁকে খেলানোর সিদ্ধান্তটা হয়ে থাকলে বোধহয় সৌরাষ্ট্রর এই তরুণ মিডিয়াম পেসারকে ও ভাবে ম্যাচ শুরুর কুড়ি ঘণ্টা আগে নিশ্চিন্তে রাস্তায় নেমে আরব সাগরের হাওয়া খেতে দেখা যেত না।
দশ বলে দশ রান ও বাউন্ডারির ধারে নেওয়া অসাধারণ একটি ক্যাচ ছাড়া ক্রিস লিনের কোনও অবদান নেই এই ম্যাচে।
অন্য দিকে উনাদকাট ৩-০-৪৯-০। তাঁর অবদান নিয়ে এর বেশি যত না বলা যায় ততই ভাল।
মর্নি মর্কেলের চোট কি না, জানতে চাইলে অবশ্য রাতে ওয়াংখেড়ে ছাড়ার আগে পর্যন্ত টিমের পক্ষ থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তবে ম্যাচ শুরুর আগে তাঁকে প্র্যাকটিস করতে দেখা যায় টিমের সঙ্গে।
পাওয়ার প্লে-তে উথাপ্পা, গম্ভীররা যেখানে রানটা টেনে নিয়ে যান ৬৯-০-য়, সেখানে ১০০-য় পৌঁছতে তাঁদের লেগে যায় আরও ৩৫ বল। ওখান থেকেই নাইটদের হারের শুরু। সূর্যকুমার যাদব আগের দিন তিন নম্বরে নেমে বড় রান পাওয়ার পর কেন হঠাৎ ফর্মে না থাকা সাকিবকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠিয়ে দেওয়া হল, সেটাও বড় প্রশ্ন। এই উইকেটে ঠিক কী ভাবে ব্যাট করতে হয়, তা এ বার পোলার্ডের ইনিংসের ভিডিও চালিয়ে হয়তো গম্ভীরের দলের ব্যাটসম্যানদের শেখাতে হবে জাক কালিসকে।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী দলে থাকতে পারেননি পোলার্ড। আইপিএলেও এ পর্যন্ত তেমন সাফল্য পাননি। যখন নেমেছিলেন, তখন ৪২ বলে ৬৯ রান দরকার মুম্বইয়ের জয়ের জন্য। যখন জিতিয়ে মাঠ ছাড়লেন দু’ওভার বাকি! তাঁর চেহারার মতোই দৈত্যাকৃতি পোলার্ডের ইনিংসটাও।
তাঁর স্বদেশীয় আন্দ্রে রাসেল এ দিন জীবনের দুশোতম টি-টোয়েন্টি খেলতে নেমেছিলেন। শোনা গিয়েছিল, টিম হোটেলে ‘রাসেল ২০০’ টপিং করা একটা কেক নাকি তৈরি রাখতে বলা হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার রাতে নাইটদের ‘আইসিং অন দ্য কেক’ তো হলই না, কেকটাই কাটা হবে কি না সন্দেহ।