অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য


রোজ রাতে ইঞ্জেকশন। আর তাতেই দিনভর ঝিম মেরে পড়ে থাকা স্টেশনের ধুলোয়।

এমন ভাবে ‘অসুস্থ’ সাজিয়ে ‘ছেলে’ ভাড়া করে দিব্যি চলছিল ব্যবসা। চিকিৎসার নামে ঝপাঝপ ‘মা’-এর কোলে জমা পড়ত টাকা।

এমনই চলছিল গত পনেরো দিন ধরে। হাবরা স্টেশনে ফ্লাইওভারের উপরে ‘মা-ছেলে’কে রোজই দেখতেন অনেকে। তাঁদেরই একজন রমা রায়। আগে দু’দিন টাকা দিয়েছেন। শনিবার হাবরার হিজলপুকুরের বাসিন্দা রমাদেবী যাচ্ছিলেন গোবরডাঙা প্রীতিলতা বয়েজ স্কুলে। সেখানেই শিক্ষকতা করেন।

এ দিন ‘মা’কে দেখে রমাদেবী জানতে চান, ছেলের অসুখটা কী। জবাব মেলে, ব্রেন টিউমার। এসএসকেএম হাসপাতালে রোজ গিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে আনতে হয়। চিকিৎসার কাগজপত্র দেখতে চান রমা। কিন্তু কিছুতেই রাজি নয় ‘মা’। শেষে উঠে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে ছেলে কোলে। রমাদেবী মহিলার হাত চেপে ধরেন। আশপাশের লোকজনও ঘিরে ধরে। মহিলা আর তার ‘ছেলে’কে নিয়ে যাওয়া হয় হাবরা জিআরপি ফাঁড়িতে।



রমাদেবীর অভিযোগ, হাবরা জিআরপি প্রথমে গুরুত্বই দিতে চায়নি। কিন্তু মহিলার কথায় অসঙ্গতি ছিল। কখনও বলে, তার বাড়ি বারাসতে। কখনও বলে মানিকতলায়। ছেলে নাকি তার বোনের, এমনও বলে ফেলে একবার।  ইতিমধ্যে ছেলেটির মুখ থেকে কখন যেন সরে গিয়েছে কালো কাপড়ের ঢাকনা। ঝিমিয়ে থাকা ছেলেটি নড়েচড়ে ওঠে। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে, তার বাড়ি ওড়িশায়। এই মহিলাকে সে ডাকে ‘বড়মা’ বলে। বড়মার কাছে থাকে তার মতো আরও ছোট ছোট কয়েকটি বাচ্চা। সকলকে রোজ রাতে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। তাতে দিনভর ঝিমুনি থাকে। সকালে মাস্ক (সাদা কাপড়ের ঢাকনা) পরিয়ে ভিক্ষে করতে আনা হয়। মাস্ক পরালে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। নড়তে চড়তে ইচ্ছে করে না।

রমাদেবী বলেন, ‘‘ছেলেটার কথা শুনে আমরা তাজ্জব। ওকে দিয়ে ভিক্ষে করানো হচ্ছিল। ছেলেটা জানায়, ঠিকমতো রোজগার না হলে খেতেও দেওয়া হতো না।’’

বনগাঁ জিআরপি-র কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন রমা। শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির অভিযোগে মামলা দায়ের করে গ্রেফতার করা হয়েছে কণিকা পাত্র নামে হেদুয়ার বাসিন্দা ওই মহিলাকে। জিআরপি-র এক অফিসার বলেন, ‘‘কলকাতায় শিশুটির এক আত্মীয় থাকেন। তাঁর মহিলাকে জেরা করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জিআরপি থানায় এসেছেন। বাকি বাচ্চারা কোথায় আছে, মহিলাকে জেরা করে তা-ও জানার চেষ্টা চলছে।’’ রমাদেবী নিজেই খবর দিয়েছিলেন হাবরা চাইল্ড লাইনে। চাইল্ড লাইনের কর্মী প্রকাশ দাস জানান, পুলিশ তদন্ত করে ছেলেটিকে তাদের হাতে তুলে দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দিনভর লেগে থেকে শেষমেশ শিশুটিকে উদ্ধার করতে পেরে কেমন লাগছে?

বছর তিরিশের রমা বলেন, ‘‘আমার বাড়িতে ওই বয়সের মেয়ে আছে। সব শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।’’