মানালসু একটি নদীর নাম। অনেকে বলেন, মানালি নামটা এসেছে মানালসু নদীর নাম থেকে। পাহাড় ঘেরা এই শহরকে দুটো ভাগে ভাগ করেছে মানালসু নদী-- পুরনো ও নতুন মানালি। কুল্লু বা কুলু থেকে যখন মানালি যাবেন, তখন আগে পড়ে নিউ মানালি। নতুন মানালির মধ্যে পড়ে বাস স্ট্যান্ড, মলরোড দোকানপাট এবং বেশিরভাগ হোটেল। মলরোড ছাড়িয়ে উত্তর দিক বরাবর হাঁটলে দেখা হবে ডুঙরি জঙ্গলের সঙ্গে। সেখান থেকে আর একটু এগিয়ে নদী পেরোলেই পুরনো মানালি।

অনেকে বলেন, ব্রাহ্মণ বিধান-কর্তা মনুর নাম থেকে মানালির নামকরণ। ‘মানালি’ শব্দের অর্থ ‘মনুর বাড়ি বা বাসভূমি’। মনুর বাড়ি বা আলয় (মনু+আলয়) থেকেই মানালি। পুরাণে আছে, ঋষি মনু তাঁর নৌকা থেকে মানালিতে নেমেছিলেন মানুষকে নবজীবন দিতে। প্রবল বন্যায় পৃথিবী আক্রান্ত হওয়ার পরে মানালি 'দেব উপত্যকা' নামে পরিচিত হয়। পুরনো মানালিতেই আছে বিখ্যাত মনু মন্দির।

মনু মন্দির-
গাড়িটা যেখানে থামল, সেখান থেকে সরু গলির রাস্তা ধরে একটু এগোলেই মনু মন্দির। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ভেতরটা বেশ প্রশস্ত। গর্ভগৃহে মনুঋষির কষ্টিপাথরের মূর্তি। চারপাশে আরও মূর্তি। মন্দিরের বারান্দা থেকে বরফের পাহাড় যেন হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। সামনের উপত্যকায় অসংখ্য আপেল গাছ। ছবিটা সিমলার কথা মনে করিয়ে দিল। সিমলায় গাছে আপেল দেখা হয়নি, এখানেও হল না!

মন্দিরের গায়ে লেখা মনু-মাহাত্ম্য। পুরাণ মতে, মনু ছিলেন বলেই আমরা আছি। অনেকে বলেন, মনু কারও নাম নয়, এটা একটা উপাধি। কালে কালে অনেক মনু এসেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিবস্বত নামের এক মনু। প্রলয়কালে যখন গোটা পৃথিবী জলে ডুবে গেল, তখন বিবস্বত মনু পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব বাঁচাতে তাদের সবার একটি করে বীজ নিয়ে একটি নৌকায় পাড়ি দেন। কিন্তু মাঝপথে ঝড়ঝঞ্ঝায় সেই তরী ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলে বিষ্ণুর মৎস্য অবতার আর বাসুকি নাগের সাহায্যে মনু হিমালয়ের এই জায়গায় পৌঁছন। এখানে জল ওঠেনি, তাই সমস্ত প্রাণিকুল রক্ষা পায়। এও শোনা যায়, মানালির কাছেই একটা জায়গায় একজন মহিলা গোবর কুড়োতে গিয়ে অজান্তে এক মূর্তির গায়ে আঘাত করে ফেলেন। তিনি দেখেন, মূর্তির শরীরের আঘাত দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। মহিমা বুঝে সেই মূর্তিকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেটাই মনুর মূর্তি, সেটাই মনু মন্দির। ১৯৯১ সালে মন্দিরের আমূল সংস্কার হলেও মূল গর্ভগৃহটি বহু প্রাচীন।

পুরনো মানালিতে দুটো পুরনো মন্দির। হিড়িম্বা দেবী আর মনু ঋষির। পাণ্ডব রাজপুত্র ভীমের স্ত্রী হিড়িম্বা দেবী হলেন ‘মানালির মা’। গোটা কুলু জেলা জুড়ে দেবী হিড়িম্বা ও তাঁর পুত্র ঘটোৎকচের প্রচুর ভক্ত। দশেরা কুলুর সব থেকে বড় উত্‍সব। পাঁচশো বছরের প্রাচীন মন্দির থেকে রথে করে দেবীর মূর্তি আনা হয়ে ধলপুরে। ঢাক, ঢোল, সানাই, কাঁসরের শব্দে দেবীর আগমন হয় ধলপুর মাঠে। ওই রথকে অনুসরণ করেই ঢোকে রাজা রামের রথ। সাত দিনের এই উৎসবে জেলার ছোট-বড় সব মন্দির থেকে রথে করে বা মানুষের কাঁধে চেপে আসেন দেব-দেবীরা। আগের লেখায় বলেছি, আবারও বলছি, যদি কখনও দশেরার সময় সিমলা-মানালি যান, তাহলে দশেরার দিনটা অবশ্যই কুলুতে কাটাবেন। অভিজ্ঞতাটা জীবনে ভুলতে পারবেন না। কুলুতেও রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ে বড় বড় দেবদারু গাছ। এখানে দেবদারু গাছেরাও সম্মানে দেব-দেবীদের থেকে কম যায় না।

হিড়িম্বা বা হাড়িম্বা দেবীর মন্দির-
ওপর দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায় না। ডুঙরি ফরেস্টের এক একটা গাছকে দেখে মনে হয়, সত্যিই যেন তারা আকাশ ছুঁয়েছে। একটা গাছকে তো ৪-৫ জন মিলেও জড়িয়ে ধরা সম্ভব নয়। বয়স কম করে ৩০০ বছর! স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, শহরের অস্তিত্ব রক্ষায় এই সব দেবদারু গাছের অবদান অনেক। না হলে, কবেই পাহাড়ের মাটি ক্ষয়ে যেত।


গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছুটা হাঁটলে সামনে হাড়িম্বা মন্দির। মন্দিরটি তৈরি ১৫৫৩ সালে। চার ধাপ বিশিষ্ট প্যাগোডার মতো মন্দির। চার পাশে অসাধারণ কাঠের কারুকাজ। কথিত আছে, পঞ্চপাণ্ডব বনবাসে থাকার সময় শক্তিমান ভীম এখানে হিড়িম্বা রাক্ষসীকে হত্যা করেন এবং তার বোন হিড়িম্বিকে বিয়ে করেন। ভিম আর হিড়িম্বির পুত্রের জন্ম হওয়ার পর পাণ্ডবরা ফিরে গেলেও হিড়িম্বি এখানে থেকে যায় এবং তপস্যায় মগ্ন হয়। ১৫৫৩ সালে রাজা বাহাদুর সিং দেবী হিড়িম্বির জন্য এই গুহা মন্দিরটি তৈরি করেন। চার চালা বিশিষ্ট মন্দিরের চতুর্থ ছাদটি ছাতার আকৃতির ধাতুর তৈরি। কাঠের শিখরের উচ্চতা প্রায় ২৪ মিটার। কাঠের দরজায় অসাধারণ কাজ করা। ভেতরের দেওয়ালে বিভিন্ন পশুর সিং দিয়ে সাজানো। মন্দিরের ভেতরে বিরাট কালো রঙের পাথর। যা ঘিরে গড়ে উঠেছে এ মন্দির। কথিত আছে, এই পাথরের নীচেই ধ্যানে মগ্ন হতেন হিড়িম্বা।



মন্দিরের সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলেই গাছের নীচে আর একটা মন্দির। হিড়িম্বার ছেলে ঘটোত্‍কচ-এর। তার সামনেই লোক সংস্কৃতি সংগ্রহশালা। ঢুকব কি ঢুকব না ভাবতে ভাবতেই টিকিট কাটলাম। ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারলাম, এখানে না এলে মানালির কিছুই যেন দেখা হত না। প্রাচীন কালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, মানুষের জীবনযাত্রা ধরা আছে এই সংগ্রহশালায়। সেখান থেকে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে গেল। বাইরে তখন ডালা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। হরেক রকম হাতের কাজ, ঘর সাজানোর জিনিস, পোশাক, গয়না। ভালই বুঝতে পারছিলাম, রেগে যাচ্ছেন আমাদের গাড়ির চালক। কিন্তু কেনাকাটার লোভ সামলানো গেল না। বেশ কিছু কেনাকাটার পর ফেরার জন্য গাড়িতে উঠলাম। গোমড়া মুখে গাড়ি চালাতে চালাতে একটাও কথা বললেন না চালক।

আগে যা লিখেছি -

মানালির পথে-৫: মেঘ-পাহাড়ের সোলাং ভ্যালিতে বরফের শিবলিঙ্গ!

মানালির পথে-৪: ঘোড়ার পিঠে ‘অ্যাডভেঞ্চার ভ্যালি’র খোঁজে
মানালির পথে-৩: বিপজ্জনক সুড়ঙ্গের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর সুন্দর ৪ মিনিট!!
মানালির পথে-২: তারপর যে-তে যে-তে যে-তে, এক নদীর সঙ্গে দেখা...
সিমলা থেকে ভারতের সুইজারল্যান্ড-এর পথে
সিমলার ডায়েরি (তৃতীয় দিন): ভাইসরিগ্যাল লজ... মাশোবরার আপেল বাগান... পাহাড়ের মাথায় গল্ফগ্রিন...!
সিমলার ডায়েরি (দ্বিতীয় দিন): অভয়ারণ্যে কৃষ্ণসার... কুফরির ঘোড়া.... বিশ্বের দীর্ঘতম হনুমান মূর্তি!
সিমলার ডায়েরি (প্রথম দিন): মল রোড, দ্য রিজ, লোয়ার বাজার, গর্টন ক্যাসেল, স্টেট মিউজিয়াম
‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়: হিমালয়ের কোল বেয়ে খেলনা ট্রেনে কালকা থেকে সিমলা