নয়াদিল্লি: শেষ দিন পর্যন্ত ভারতের গণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় বিশ্বাস ছিল অটুট। তাই আস্থা ছিল ইতিহাস নিশ্চয়ই সদয় হবে তাঁর উপর। কিন্তু সেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারলেন না দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ৯২ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সন্ধেয় আচমকাই স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। তড়িঘড়ি দিল্লির AIIMS-এ ভর্তি করা হয় তাঁকে। কিন্তু যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখনই শ্বাসকষ্ট গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠেছিল বলে জানা যায়। তড়িঘড়ি ICU-তে ভর্তি করা হয় তাঁকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। চলে গেলেন মনমোহন।


দিল্লি AIIMS জানিয়েছে, 'বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার চিকিৎসা চলছিল। ২৬ ডিসেম্বর হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান তিনি।  বাড়িতেই তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শুরু হয়। রাত ৮টা বেজে ৬ মিনিটে হাসপাতালে আনা হয় তাঁকে। কিন্তু সব চেষ্টা সত্ত্বেও ওঁকে ফেরোনা যায়নি। রাত ৯টা বেজে ৫১ মিনিটে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়'।


এদিন AIIMS-এ পৌঁছন কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়ঙ্কা গাঁধী, সনিয়া গাঁধী, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে। পৌঁছন বিজেপি-র বিজেপি নাড্ডাও। রাহুল গাঁধী বেলগাভিতে ছিলেন দলীয় কর্মসূচিতে। দিল্লি ফিরে আসছেন তিনি।



১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পঞ্জাবের গাহ্-তে শিখ পরিবারে জন্ম মনমোহনের, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। ছোট বয়সে মাকে হারান। ঠাকুমার কাছেই মানুষ মনমোহন। প্রথমে উর্দু মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষা। গুরুমুখী, পাঞ্জাবিও জানতেন।  দেশভাগের পর ভারতের অমৃতসরে চলে আসে মনমোহনের পরিবার। সেখানে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তিনি। পঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।


ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজে অর্থনীতি নিয়ে এর পর পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে নজির গড়েন। ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্টে DPhil করেন মনমোহন।  দেশে ফিরে বেশ কয়েক বছর অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপুঞ্জের বাণিজ্য এবং উন্নয়ন বিভাগে যোগ দেন।  ১৯৮২ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর নিযুক্ত হন মনমোহন।  সেই সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। 


প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান, সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব সামলানোর পর জেনিভার একটি থিঙ্কট্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ হিসেবেও কাজ করেছেন। ১৯৯১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যআন হন মনমোহন। এর পর ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ। মনমোহনের হাতেই ভারত মুক্ত অর্থনীতি হয়ে ওঠে। যে দু'ফায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৭ সালে তাঁর আমলেই ভারতের GDP সর্বোচ্চে গিয়ে ঠেকে, ৯ শতাংশে। পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে উঠে আসে ভারত। 
উদার অর্থনীতি


দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তো বটেই, অর্থমন্ত্রী হিসেবেও ভারতের অর্থনীতিতে সংস্কার ঘটিয়েছিলেন মনমোহন। ১৯৯১ সালে দেশের রাজস্ব ঘাটতি যখন ৮.৫ শতাংশে, সেই সময় গোটা বিশ্বের সামনে ভারতের বাজার উন্মুক্ত করে দেন তিনি। উদার অর্থনীতির দরজা খুলে দেন। ভারতের অর্থনীতির ভিত মজবুত করেন মনমোহন। 


১৯৫৮ সালে গুরশরণ কৌরের সঙ্গে বিয়ে হয় মনমোহনের। তাঁদের তিন মেয়ে রয়েছে, উপিন্দর, দামন এবং অমৃত। ১৯৮৪ সালের শিখ দাঙ্গার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন মনমোহন। দলের হয়ে তিনি ক্ষমা চান। তিনি সনিয়া গাঁধীর হাতের পুতুল ছিলেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ করলে, কখনও কারও প্রতি রুষ্ট হননি মনমোহন। তাঁকে 'মৌনমোহন' বলেও কটাক্ষ করা হয়। কিন্তু মনমোহনের বক্তব্য ছিল, "মিডিয়া না হলেও, ইতিহাস নিশ্চয়ই তাঁর প্রতি সদয় হবে।" একাধিক বার বাইপাস সার্জারি হয়েছিল মনমোহনের।