নয়াদিল্লি: একদিকে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন। অন্য দিকে মহাকুম্ভে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পুণ্যস্নান। বুধবার সেই নিয়ে যখন ব্যস্ত গোটা দেশ, তার মধ্যেই লজ্জার অধ্যায় রচিত হল। বেআইনি ভাবে অনুপ্রবেশকারী ভারতীয়দের নিয়ে ভারতের মাটিতে অবতরণ করল আমেরিকার সেনার বিমান। পঞ্জাবের অমৃতসরে সেই বিমান নামলেও, তার ধারেকাছে ঘেঁষতে পারেনি সংবাদমাধ্যম। এমনকি বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে চাপিয়ে ভারতীয়দের বের করে আনার সময়ও কাছে যেতে দেওয়া হয়নি কাউকে। কিন্তু একটি রাত কাটতেই একে একে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে শুরু করলেন আমেরিকা ফেরত ভারতীয়রা। (Illegal Indian Migrants)


ভাল ভাবে বাঁচতে, ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে বছর বছর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দলে দলে আমেরিকা, কানাডার মতো দেশে ঢোকার চেষ্টা করেন। গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। কিন্তু বেআইনি ভাবে যে বা যাঁরা ঢুকে পড়তে পেরেছিলেন সেদেশে, তাঁদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে। কারণ গত বছর দো বাইডেন শয়ে শয়ে ভারতীয় অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে ডোনাল্ড ট্রাম্পও সেই কাজে হাত দিয়েছেন। ১৮০০০ ভারতীয় অভিবাসীকে আপাতত চিহ্নিত করেছে ট্রাম্প সরকার, যার মধ্যে বুধবার প্রথম দফায় ১০৪ জনকে ভারতে ফেরত পাঠায় তারা। (Donald Trump Sends Indian Migrants)


হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল পরানো অবস্থায় ভারতীয়দের বিমানে তোলার ভিডিও পোস্ট করেছেন আমেরিকার বর্ডার প্যাট্রোল বিভাগের প্রধান মাইকেল ডব্লিউ ব্য়াঙ্কস। তাঁর বক্তব্য, 'USBP ভারতের বেআইনি এলিয়েনদের ফেরত পাঠাতে সফল হল। সেনার বিমান ব্যবহার করে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূরত্বে অভিবাসী ফেরত পাঠানো হল। বেআইনি ভাবে প্রবেশ করলে, ফেরত পাঠানো হবে'।



এখনও পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান সামনে এসেছে, তাতে জানা গিয়েছে, ওই ১০৪ জনের মধ্যে গুজরাত ও হরিয়ানা থেকে ৩৩ জন, পঞ্জাব থেকে ৩০ জন, মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশ থেকে ৩ জন, চণ্ডীগড় থেকে ২ জন করে রয়েছেন। ১৯ জন মহিলা, ১৩ জন আবার নাবালক-নাবালিকা। এমনকি ৪, ৫, ৭ বছরের শিশুও রয়েছে। দেশে ফিরে তাঁরা যে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন, তা ভয় যথেষ্ট আতঙ্কের। দেশে ফেরা ভারতীয়রা জানিয়েছেন, দুর্গম পাহাড়, ঘন জঙ্গল পেরিয়ে, শত শত কিলোমিটার হেঁটে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। একটাই স্বপ্ন ছিল, যেনতেন প্রকারে আমেরিকায় পৌঁছনো। তার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচও করেন। কথা ছিল, আমেরিকার সীমান্তে পৌঁছে বৈধ উপায়েই সেদেশে ঢুকতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু আমেরিকার সীমান্তে পৌঁছে স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার পরিবর্তে অকল্পনীয় যন্ত্রণার মুখোমুখি হন তাঁরা। হাতে হাতকড়া পরানো হয়, পায়ে পরানো হয় বেড়ি, কোমরেও শিকল বাঁধা হয়। 


পঞ্জাবের গুরুদাসপুরের বাসিন্দা জসপাল সিংহ জানিয়েছেন, আমেরিকায় প্রবেশ করতে এক এজেন্টকে ৩০ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। প্রথমে ব্রাজিলে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সেখান থেকে ফের বিমান ধরার কথা থাকলেও, ‘Donkey Route’-এ বিপজ্জনক ভাবে পথচলা শুরু হয়। ছ’মাস ব্রাজিলেই কেটে যায় তাঁর। তার পর যন্ত্রণাবিদ্ধ যাত্রা শেষে যাও বা আমেরিকার সীমান্তে পৌঁছন, সেখানে আমেরিকার সীমান্তরক্ষী বাহিনী গ্রেফতার করে তাঁকে। ১১ দিন বন্দি করে রাখা হয়। সেনার বিমানে চাপিয়ে যে ভারত ফেরত আনা হচ্ছে তাঁকে, তা টেরও পাননি জসপাল। অন্য কোনও বন্দিশিবিরে নিয়ে যাচ্ছে বলেই বেবেছিলেন। অনেক পরে আসল সত্য জানতে পারেন। তত ক্ষণে হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে, পা বাঁধা হয়েছে শিকলে। সেই অবস্থায় অমৃতসরে নামেন তাঁরা। 



পঞ্জাবের হোশিয়ারপুরের হরবিন্দর সিংহ জানিয়েছেন, এক এজেন্টকে ৪২ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কাতার, ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, পানামা, নিকারাগুয়া এবং মেক্সিকো হয়ে আমেরিকার সীমান্তে পৌঁছন। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হরবিন্দর বলেন, “আমরা দিনের পর দিন হেঁটেছি। পাহাড় পেরিয়েছি, সাগরে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। জঙ্গলে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছি একজনকে। সমুদ্রে ডুবে যান আর একজন।” এর এক ভারতীয় অভিবাসী বলেন, “১৭-১৮টি পাহাড় পেরোয়। পা পিছলে গেলে আর রক্ষে ছিল না। আহতদের সেখানেই মরতে ফেলে রেখে এগিয়ে যাওয়াই নিয়ম। রাস্তায় অনেক মৃতদেহ দেখেছি।”


দরাপুরের সুখপাল সিংহ জানিয়েছেন, সমুদ্রপথে ১৫ ঘণ্টা কাটে। এর পর ৪০-৪৫ কিলোমিটার ছিল দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা। সীমান্ত টপকানোর আগে মেক্সিকোতেই ধরা পড়েন তাঁরা। ১৪ দিন অন্ধকার জেলের কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল। সূর্যের আলো পর্যন্ত চোখে পড়েনি। তিনি দানিয়েছেন, পঞ্জাবের হাজার হাজার যুবক, পরিবার, শিশু ওই অবস্থায় এখনও রয়েছেন। স্বপ্নপূরণে জমি-জমা বেচে, ঋণ নিয়ে কেউ কেউ টাকা দিয়েছিলেন এজেন্টকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়ে বেড়ি পরিয়ে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে কুখ্যাত অপরাধীর মতো দেশে ফেরত পাঠানো হল তাঁদের। 


কিন্তু দেশে ফেরার পরও শান্তি মেলেনি। অমৃতসরে নামার পরই দফায় দফায় ভারতীয় অভিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে একাধিক তদন্তকারী সংস্থা। গোটা ঘটনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে। বিরোধী শিবিরের রাজনীতিক থেকে, সাধারণ মানুষ, সরকারের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলছেন সকলেই। বৃহস্পতিবার সেই নিয়ে সংসদে বিক্ষোভও দেখান বিরোধীরা, যার জেরে দুপুর পর্যন্ত লোকসভা এবং রাজ্যসভার অধিবেশন স্থগিত হয়ে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। কিন্তু ভারতের বিদেশনীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মোদি জমানাতেই আমেরিকা থেকে এভাবে হাতকড়া, শিকল পরিয়ে ভারতীয় অভিবাসীদের ফেরত পাঠাল আমেরিকা। আগামী সপ্তাহেই আমেরিকায় যাওয়ার কথা মোদির। সেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ আলোচনার কথা রয়েছে তাঁর। কিন্তু তার আগে ভারতীয় অভিবাসীদের সঙ্গে যে আচরণ করল আমেরিকা, যেভাবে ভারতের মাটিতে আমেরিকার সেনার বিমান নামল, তাতে বন্ধুত্বের সম্ভাষণ এক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। 


নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে দ্বিতীয় বার আমেরিকায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই অভিবাসী বিতাড়নে সক্রিয় হয়েছে আমেরিকা। গুয়াতেমালা, কলম্বিয়া, হন্ডুরাসের মতো দেশের অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কলম্বিয়া অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দেয়। দেশের প্রেসিডেন্ট গুস্তাভ পেত্রো আমেরিকার সেনার বিমানকে দেশের মাটিতে নামতে দেননি, নাগরিকদের হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল পরাতে দেননি। নিজে থেকে বিমান পাঠিয়ে সসম্মানে নাগরিকদের ফিরিয়ে আনেন তিনি। এমনকি দেশে ফিরে যাতে তাঁরা নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেন, তার জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। কিন্তু ভারতের তরফে তেমন কোনও পদক্ষেপই চোখে পড়ল না।