নয়াদিল্লি: কোণঠাসা, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা হিসেবেই আজ পরিচিত। কিন্তু ইতিহাস জানে বরাবর এমন ছিল না প্যালেস্তাইন। রোম সাম্রাজ্যের অধীনে থাকাকালীন বিশ্বে অন্যতম সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে গন্য হতো। বিবিধের মাঝে মিলন মহান বলতে যা বোঝায়, ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী ওই অঞ্চল সেই হিসেবেই বিবেচিত হতো। পরবর্তী কালে মামলুক জমানায় ইসলামি শাসন কায়েম হলেও, গরিমায় আঁচ পড়েনি এতটুকু। বরং মিশরের সিনাই উপদ্বীপ থেকে অধুনা ইজরায়েলের অন্তর্গত সিজারিয়া শহর পর্যন্ত সাজানো-গোছানো জনবসতি ছিল। বিশেষ করে তুরস্কের ওটোমান সাম্রাজ্যের সময়কালটি প্যালেস্তাইনের জন্য ছিল স্বর্ণযুগ। কিন্তু ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ আক্রমণের পর থেকেই ভাঙন শুরু হয়। (Israel Palestine War)


কিন্তু গত সাত দশকের সময়কালের সঙ্গে তুলনা টানলে হিসেব মেলে না। ইজরায়েলি আগ্রাসনের সামনে ক্রমশ গুটিয়ে যেতে যেতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে প্যালেস্তাইন। সুখ, সমৃদ্ধির উত্তরাধিকার আজ বিস্মৃত। বিগত সাত দশক ধরে অস্তিত্ব সঙ্কটের লড়াই লড়েছেন নিরীহ প্যালেস্তিনীয়রা। একচিলতে জায়গায় গাদাগাদি করে গাজায় কোনও রকমে বাস করছেন লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তিনীয়। ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৬-১২ কিলোমিটার চওড়া এবং সাকুল্যে ৩৬২ বর্গকিলোমিটার জায়গায় মাথা গুঁজে রয়েছেন ২০ লক্ষের বেশি মানুষ। যে কারণে গাজা আজ বিশ্বের তৃতীয় ঘনবসতি এলাকা হিসেবে পরিচিত। (Israel Palestine Conflict)


নাৎসি আগ্রাসনের মুখে জার্মানি এবং সংলগ্ন অঞ্চল থেকে ইহুদিরা যখন প্রাণ হাতে করে পালাচ্ছেন, সেই সময় আমেরিকা, ইউরোপ তথা পশ্চিমের দেশগুলিতে ঠাঁই হয়নি তাঁদের। সেই অবস্থায় প্যালেস্তাইনে ভিড় করতে শুরু করেন ইহুিদিরা। ব্রিটেনের তৎকালীন বিদেশ সচিব আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদি নেতা লায়োনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে চিঠি লিখে জানান, প্যালেস্তাইনকে ইহুদিদের ভূমি ঘোষণা করতে রাজি ব্রিটেন। তার পর থেকেই জলস্রোতের মতো ইহুদিরা ভিড় করতে শুরু করেন প্যালেস্তাইনে। সেই সময় প্যালেস্তাইনে ইহুদিদের জনসংখ্যার হার ছিল ৯ শতাংশ। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত তা বেড়ে ২৭ শতাংশ হয়।


এর জন্য ১৯৪৮ সালের 'নাকবা'কে দায়ী করেন প্যালেস্তিনীয়রা। আরবি শব্দ ''নাকবা'র অর্থ বিপর্যয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই বিপর্যয় বুকে বয়ে নিয়ে চলেছেন প্যালেস্তিনীয়রা। কারণ ১৯৪৭ সালে ১৮১তম প্রস্তাবে প্যালেস্তাইনকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। ঠিক হয়, প্যালেস্তাইনকে ভেঙে একটি ইহুদি দেশ এবং একটি আরব দেশ তৈরি করা হবে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পৃথক ইজরায়েল রাষ্ট্রের গঠন হয়। আর তার সঙ্গেই সূচনা হয় অস্তিত্বরক্ষার রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের। ১৯৪৯ সালে ইজরায়েলের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার প্যালেস্তিনীয় ঘরছাড়া হন। এর পর ওই অঞ্চল তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, পৃথক রাষ্ট্র ইজরায়েল, জর্ডান নদীর তীরের ওয়েস্ট ব্য়াঙ্ক, এবং গাজা।


তার পর থেকে পশ্চিমি বিশ্বের তরফে ইহুদিদের পক্ষে সমর্থন যত বেড়েছে ততই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন প্যালেস্তিনীয়রা। ছেড়ে দিতে হয়েছে ঘরবাড়ি, সম্পত্তি এমনকি মাতৃভূমির উপর নিজেদের অধিকারও। দেশ ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হলেও নিস্তার মেলেনি। রাষ্ট্রপুপঞ্জের হিসেব অনুযায়ী, বিগত ৭৫ বছরে নিজ ভিটে থেকে উৎখাত হতে হয়েছে ৭ লক্ষের বেশি প্যালেস্তিনীয়কে।  শুধুই কোণঠাসা হয়ে পড়া নয়, পশ্চিমি শক্তির সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের উপর ইজরায়েল অত্যাচার শুরু হয়। বিক্ষুব্ধ প্যালেস্তিনীয়দের সমবেদনা জানানোর পরিবর্তে, তাঁদের উপর দমন-পীড়ন শুরু হয়।


আরও পড়ুন: Israel-Palestine War: ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন যুদ্ধে 'এন্ট্রি' লেবাননের, আকাশসীমা লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ! বড় ধরনের হামলার আশঙ্কা


প্যালেস্তাইন দখলের পর ইজরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লেভি ইশকোল বলেন, "জল না পেলেই আর কোনও উপায় থাকবে না ওঁদের। ফসলের বাগান হলুদ এবং বিবর্ণ হয়ে যাবে।" অর্থাৎ প্যালেস্তিনীয়দের ভাতে মারার পন্থা অবলম্বন করতে দেখা যায় ইজরায়েলকে। যে কারণের বিংশ শতকের শেষ দিকে ৭০ শতাংশ প্যালেস্তিনীয় কর্মহীন হয়ে পড়েন। দরিদ্রসীমার নীচে চলে আসেন ৮০ শতাংশ প্যালেস্তিনীয়। 


অভাব, দুর্দশা যত গ্রাস করেছে, ততই আগ্রাসী হয়ে ওঠেন প্যালেস্তিনীয়রা একাধিক বিক্ষুব্ধ সংগঠন গজিয়ে ওঠে। যত দিন এগিয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যায় উপচে পড়েছে গাজা। মাথা গোঁজার একচিলতে জায়গা খুঁজতে গিয়ে মাঠ-ঘাট, রাস্তা সব মিলিয়ে গিয়েছে মানচিত্র থেকে। তার পর আবারও আঘাত নেমে আসে। ১৯৬৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইজরায়েলি সেনার দখলে চলে যায় গাজা। পরে সেনা প্রত্যাহার করলেও, কড়া নজরদারিতে রাখা হয় গাজায় বসবাসকারী প্যালেস্তিনীয়দের। দফায় দফায় চলে বোমা, গুলিবর্ষণ। ধর্মাচরণ থেকে জীবনধারণের অধিকারের উপরও নেমে আসে আঘাত। ২০০৬ সালে ফের গাজা আক্রমণ করে ইজরায়েল। হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয় কচুকাটা হন তাতে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় চলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। ২০১৪ সালে ইজরায়েলি সেনা পিছু হটতে বাধ্য হয়। 


এর পর ২০১৮ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে বৈদেশিক নীতি চুক্তি স্থাপনে অগ্রণী হন। কিন্তু গোড়াতেই প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের ত্রাণের জোগান দেওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের তহবিলে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় আমেরিকা। তেল আভিভ থেকে আমেরিকার দূতাবাস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় জেরুসালেমে, তাতে ইজরায়েলের স্বার্থরক্ষা হলেও, প্যালেস্তাইন এবং পশ্চিম এশিয়ার অন্য দেশগুলি আমেরিকার সমালোচনায় সরব হয়। কারণ ইজরায়েল গোটা জেরুসালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে। প্যালেস্তিনীয়রা আবার ভবিষ্যতের প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুসালেমের উপর দাবি জানান। এর পর আমেরিকার শান্তি প্রস্তাবে ওয়েস্ট ব্য়াঙ্ক এবং অবিভক্ত জেরুসালেমের উপর ইজরায়েলি কর্তৃত্ব কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হলে, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্যালেস্তাইন।  


২০২০ সালের অগাস্ট মাসে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং বাহরাইন বিষয়টি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে এগোয়। তাতে শামিল হয় আমেরিকা-সহ পশ্চিম এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ। অ্যাব্রাহাম চুক্তির প্রস্তাবও আনা হয়, কিন্তু প্যালেস্তাইন তাতে রাজি হয়নি। সে বছর অক্টোবরে ইজরায়েলের আদালত পূর্ব জেরুসালেম থেকে বেশ কিছু প্যালেস্তিনীয় পরিবারকে উৎখাতের নির্দেশ দেয়। তাঁদের জমাজমা, সম্পত্তি তুলে দিতে বলা হয় ইহুদিদের হাতে।  তারও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়। ২০২১ সালে এপ্রিল মাসে জেরুসালেমের রাস্তায় আন্দোলনে নামেন প্যালেস্তিনীয়রা। শেখ জারা থেকে ইজরায়েলিদের সরানোর দাবিতে রাতের পর রাত ধরে চলে ধর্না। মে মাসে তাতে সিলমোহর দেয় আদালত। সেই নিয়েও অশান্তি শুরু হয়। সেই সময় আল-আকসা মসজিদ চত্বরে পুলিশের বিরুদ্ধে গুলি, গ্রেনেড এবং ছররা বন্দুক থেকে রবারের বুলেট ছোড়ার অভিযোগ ওঠে। শয়ে শয়ে প্যালেস্তিনীয় নাগরিক আহত হন তাতে।


শীঘ্রই অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। দ্রুত তা সামরিক লড়াইয়ে পরিণত হয়। গোলাগুলি, বোমাবাজি, রকেট হামলার ঘটনা সামনে আসে। তাতে ২০ জন প্যালেস্তিনীয়র মৃত্যু হয়। আকাশপথে ইজরায়েল হামলা চালায়, বসতি এলাকা, এমনকি শরণার্থী শিবিরেও বোমা ফেলা হয় বলে অভিযোগ সামনে আসে। ২০২১ সালের মে মাসে ইজরায়েল এবং 'হামাস' অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়। দুই পক্ষই বিজেদের বিজয়ী ঘোষণা করে। তাতে প্রায় ৩০০ প্যালেস্তিনীয় মারা যান। আহত হন প্রায় ২০০০ মানুষ। ১১ দিনের লড়াইয়ে মারা যান ১৩ জন ইজরায়েলি নাগরিক। ওই লড়াইয়ে গাজায় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জ জানায়, প্রায় ৭২, ০০০ প্যালেস্তিনীয় নাগরিক গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।  


তার পর বিগত কয়েক মাস ধরেই ফের অশান্তির আঁচ টের পাওয়া যেতে শুরু করে। গাজাকে অর্থনৈতিক ভাবে অবরুদ্ধ করে ফেলে ইজরায়েল। কাজের খোঁজে বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ হয় প্যালেস্তিনীয়দের। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসপত্রের সরবরাহও বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর এপ্রিল মাসে আল আকসা মসজিদের প্রার্থনাসভায় সমবেত হয়েছিলেন প্যালেস্তিনীয়রা। সেই সময় ইজরায়েলি বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। এর পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর ইজরায়েলি নাগরিকরা মসজিদে ভিড় করেন। সেখানে গন্ডগোল হলে প্যালেস্তিনীয়দের মসজিদে ঢুকতে বাধা দেয় ইজরায়েলি সেনা। দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সেই থেকেই পরিস্থিতি তেতে উঠতে থাকে। শনিবার নতুন করে যুদ্ধের সূচনা হয়। ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইনের মধ্যে যুদ্ধে এই মুহূর্তে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্র যেখানে ইজরায়েলকে সমর্থন করছে, ইরান, লেবানন এবং সিরিয়ার তরফে সমর্থন যাচ্ছে প্যালেস্তিনীয়দের দিকে। সৌদি আরবের মতো দেশ যেখানে বরাবর সমর্থন জুগিয়ে এসেছে প্যালেস্তাইনকে, ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে ছেদ পড়ার আশঙ্কায় তারা কার্যতই নীরব। ফলে আরও বেশি করে বিচ্ছিন্ন এবং একাকী বোধ করছেন প্যালেস্তিনীয়রা। নিজেদের দেশে শরণার্থী হয়ে থাকবেন কেন, এই প্রশ্নই ক্ষোভের উদ্রেক করছে জনমনে।