নয়াদিল্লি: দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, অধুনা প্রয়াত মনমোহন সিংহের স্মৃতিসৌধ গড়া নিয়ে টানাপোড়েন চলেছে। সেই আবহে এবার দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে চলেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার। প্রণবের মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় একথা জানালেন সকলকে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শর্মিষ্ঠা। (Pranab Mukherjee Memorial)
মঙ্গলবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘোষণা করেন শর্মিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তোলা ছবি এবং সরকারি ঘোষণাপত্রের ছবি পোস্ট করেন মাইক্রোব্লগিং সাইট X (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে। তিনি লেখেন, 'প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজির সঙ্গে দেখা করে, বাবার স্মৃতিসৌধ তৈরির সিদ্ধান্তের জন্য ওঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালাম। না চাইতেই এই সিদ্ধান্ত, তাই বেশি খুশি। প্রধানমন্ত্রীর এই অপ্রত্যাশিত এবং উদার পদক্ষেপ মন ছুঁয়ে গিয়েছে'। (Sharmistha Mukherjee)
শর্মিষ্ঠা আরও লেখেন, 'বাবা বলতেন, রাষ্ট্রীয় সম্মান যেতে চাইতে নেই। আপনা থেকে পেতে হয়। বাবার স্মৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ আমি। বাবা এখন যেখানে, তিনি প্রশংসা এবং সমালোচনার বাইরে। এর কোনও প্রভাবই তাঁর উপর পড়বে না। কিন্তু ওঁর মেয়ে হিসেবে, আনন্দ প্রকাশের ভাষা নেই আমার কাছে'।
২০২০ সালের ৩১ অগাস্ট শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রণব। মনমোহনের প্রয়াণে তাঁর স্মৃতিসৌধ নিয়ে টানাপোড়েন কাটিয়ে, চার বছরের বেশি সময় পর হঠাৎ প্রণবের স্মৃতিসৌধ তৈরিতে কেন্দ্রের বিজেপ সরকার এত উদ্যোগী হল কেন, ইতিমধ্যেই সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। আজীবন কংগ্রেসি সর্দার বল্লভভাই পটেলের সুউচ্চ মূর্তি গড়ে বিজেপি যেমন কংগ্রেসকে মাত দিতে চেয়েছিল, নেহরু বনাম পটেল ভাষ্য তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, এক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠছে। রাজঘাটেই প্রণবের স্মৃতিসৌধ তৈরি করার কথা জানিয়েছে কেন্দ্র। এই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ রাজঘাটে মনমোহনের শেষকৃত্য করা নিয়েও টানাপোড়েন হয়। সরকারি অনুমতি না পেয়ে, শেষে নিগমবোধ শ্মশানে দাহ করা হয় মনমোহনকে।
পাশাপাশি, শর্মিষ্ঠার মন্তব্যও যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। মনমোহনের স্মৃতিসৌধ তৈরির জন্য মোদিকে চিঠি লিখেছিলেন কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে। কেন্দ্রের তরফে প্রথমে তা নিয়ে সদুত্তর মেলেনি বলে জানা যায়। বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েন চরমে উঠলে, রাতের দিকে স্মৃতিসৌধ তৈরির বিবৃতি দেয় কেন্দ্র। প্রণবকে উদ্ধৃত করে 'যেচে চাইতে নেই' বলে যে মন্তব্য করলেন শর্মিষ্ঠা, তাতে কি মনমোহনের স্মৃতিসৌধ নিয়ে টানাপোড়েনের দিকেই ইঙ্গিত করলেন তিনি? কংগ্রেসকে কি বিঁধলেন প্রণবকন্যা?
বাংলা কংগ্রেসের হাত ধরে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে প্রণবের। ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে জাতীয় কংগ্রেসে টেনে নেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ইন্দিরার অতি বিশ্বস্তও হয়ে ওঠেন প্রণব। দলের অন্দরে তো বটেই, কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকারেও অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রীর মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করেন প্রণব। ইন্দিরার প্রয়াণের পর কংগ্রেসের সঙ্গে সাময়িক দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর। পৃথক রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস দলেরও প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আবারও কংগ্রেসেই ফিরে যান প্রণব। শোনা যায়, ২০০৪ সালে সনিয়া গাঁধী যখন UPA সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে অস্বীকার করেন, সেই পদের দাবিদার হিসেবে আশায় বুক বেঁধেছিলেন প্রণব। কিন্তু আচমকা মনমোহনের নাম ঘোষণা করা হয় দলের তরফে। তাতেও প্রণব ক্ষুণ্ণ হন।
শেষ পর্যন্ত, ২০১২ সালে দেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন প্রণব, যা ছিল অরাজনৈতিক পদ। সেই থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সমীকরণে বিস্তর পরিবর্তন আসে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রণবের দহরম মহরম নিয়েও প্রশ্ন ওঠে কংগ্রেসের। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে প্রণবের দূরত্ব সবচেয়ে বাড়ে ২০১৮ সালে। ততদিনের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে অবসর নিয়েছেন তিনি। সেবছর ৭ জুন বিজেপি-র অভিভাবক সংস্থা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ম সেবক সঙ্ঘের নাগপুরের প্রশিক্ষণ শিবিরে উপস্থিত হন প্রণব। আজীবন নিজের কংগ্রেসি পরিচয়কে সামনে রেখে একের পর এক উচ্চতা ছোঁয়া প্রণব কোন যুক্তিতে সঙ্ঘের শিবিরে গেলেন, সেই নিয়ে বিতর্ক বাধে। দলের তদানীন্তন মুখপাত্র টম বেদাক্কনকে বলতে শোনা যায়, "কেন গিয়েছেন, ওঁর কাছেই জানতে চান। আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি যে, ওদের সঙ্গে আমাদের আদর্শের বিস্তর ফারাক রয়েছে।"
প্রণবের প্রয়াণের পরও কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া শীতল ছিল বলে পরবর্তীতে সরব হন শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠার দাবি, প্রণবের প্রয়াণে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক পর্যন্ত ডাকা হয়নি। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে এমন হয় না বলে জানানো হয় তাঁকে। মনমোহনের প্রয়াণের পর শেষকৃত্যের স্থল এবং স্মৃতিসৌধ নিয়ে যখন কেন্দ্রের সঙ্গে টানাপোড়েন তুঙ্গে, সেই সময়ও কংগ্রেসকে কটাক্ষ করেন শর্মিষ্ঠা। তিনি নিজেও কংগ্রেসের টিকিটে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ২০২১ সালে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।