কলকাতা: দীর্ঘদিন ধরে দর কষাকষির জেরে আটকে থাকার পর অবশেষে দিনের আলো দেখতে চলেছে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়া কালাশনিকভ-চুক্তি। সব ঠিকঠাক চললে আগামী অক্টোবর মাস থেকেই সেনার হাতে অত্যাধুনিক "একে-২০৩" অ্যাসল্ট রাইফেল চলে আসতে পারে।



প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক সূত্রের দাবি, আগামী অক্টোবরে ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে যোগ দিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারতে আসার কথা। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পুতিন দুজনে মিলে ভারতের জন্য নির্মিত প্রথম একে-২০৩ রাইফেলের উদ্বোধন করতে পারেন। তার আগে সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ রুশ সফরে যাচ্ছেন। সেখানে কয়েকটি সুক্ষ্ম বিষয়বস্তুকে  চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।

দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয় সেনায়, বিশেষ করে ইনফ্যান্ট্রিতে ভাল গুণমানের রাইফেলের আকাল রয়েছে। সেনার তরফে কেন্দ্রের কাছে দীর্ঘদিন ধরে রাইফেল কেনার বিষয়ে দাবি পেশ করা হয়েছে। একাধিক রিপোর্টের মাধ্যমে বলা হয়েছে, অবিলম্বে ফৌজের জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দেওয়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতীয় সেনা দীর্ঘদিন ধরে চাইছে, দেশে তৈরি ইনস্যাস রাইফেলকে সরিয়ে এমন অত্যাধুনিক রাইফেল কিনতে যা আগামী বেশ কয়েক বছর ভারতীয় বাহিনীর প্রধান অস্ত্র হবে একইসঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও কম হবে। ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরিতে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ইনস্যাস প্রভুতভাবে ভারতীয় বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু, তার গুণমান নিয়ে বিস্তর অভিযোগও উঠেছে।

একটা সময় এটাই সেনার অন্যতম প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। অনেকে বলতেন, এটাই কালাশনিকভের ভারতীয় সংস্করণ। কিন্তু, সময়ের গ্রাসে এখন বর্তমান যুগে ইনস্যাসের কার্যকারিতা কমে গিয়েছে। উপরন্তু, ইনস্যাসের তেমন একটা আধুনিকীকরণও সম্ভব হয়নি। যে কারণে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে বাহিনীকে। অপরদিকে, শত্রুর হাতে এখন আরও আধুনিক অস্ত্র আসায় বিষয়টি আরও জটিল আকার ধারণ করে।

ইনস্যাস নিয়ে সেনার মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই এই রাইফেল নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হয়নি। বিশেষ করে, জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসদমন অভিযানে জঙ্গিদের এরে-৪৭ এর সামনে ব্যর্থ হয়েছে ইনস্যাস। যে কারণে, তড়িঘড়ি ১ লক্ষ এক-৪৭ কিনতে হয়েছিল সেনাকে।

এই পরিস্থিতিতে, ২০১৮ সালে প্রথমবার "একে-২০৩ ৭.৬২ এমএম ২০০ সিরিজ" অ্যাসল্ট রাইফেল কেনার বিষয়ে উদ্যোগী হয় কেন্দ্র। সেই বছর অক্টোবর মাসে পুতিনের ভারত সফরের সময় ইন্টার-গভর্নমেন্টাল এগ্রিমেন্ট (আইজিআই) স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই সময় প্রচণ্ড উন্মাদনা ছিল, এই সম্ভাব্য চুক্তি ঘিরে। কিন্তু, দর কষাকষিতে অনেকটা সময় চলে যায়। উভয় পক্ষই সুনির্দিষ্ট রফাসূত্রে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। যে কারণে, চুক্তির বাস্তবায়ণ নিয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়।

জট কাটাতে একটি বিশেষ কমিটিও গঠন করে কেন্দ্র। কিন্তু, তাতেও সমাধান সেই তিমিরেই থেকে যায়। এদিকে, বাহিনীতে রাইফেলের চরম সঙ্কট দেখা দেয়। যে কারণে, আপৎকালীন ভিত্তিতে গত বছর সেনা বাধ্য হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৭২ হাজার ৪০০ "সিগ সয়ার ৭১৬" অ্যাসল্ট রাইফেল আমদানি করে।

তবে, এতে বেশি অর্থ খরচ যে হয়, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ, গোটা প্রক্রিয়াটা হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে কেনার শর্তে। যার জেরে উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে। ভারতকেও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে। সেই রাইফেল ইতিমধ্যেই চলে এসেছে। এদি্কে, কালাশনিকভ জট অব্যাহত থাকায় সেনা আরও সম-পরিমাণ সিগ রাইফেল দ্বিতীয়বার বরাত দেয়।



মার্কিন নির্মিত সিগ সয়ার ৭১৬ অ্যাসল্ট রাইফেল



ভারতের সিগ রাইফেল কেনা নিয়ে রাশিয়া উষ্মাও প্রকাশ করে। মোদি সরকারও চাইছিল, দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে রাইফেল সমস্যার সমাধান করতে। সব দিক বিবেচনা করে ফের কালাশনিকভ চুক্তির বিষয়টি নতুন করে উত্থাপন করা হয়। একটা সময় বিশ বাঁও জলে চলে যাওয়া এই চুক্তিকে নতুন দিশা দেখাতে জোর তদ্বির করে কেন্দ্র। লালফিতের ফাঁস সরিয়ে কালাশনিকভ চুক্তিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে কেন্দ্রের উচ্চপর্যায় কমিটি।

প্রতিরক্ষামন্ত্রক সূত্রের খবর, সম্প্রতি ভারতের বিদেশ সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ও রুশ বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে দীর্ঘ আলাচনা হয় এই ইস্যুতে একটি রফাসূত্রে পৌঁছতে। সেখানে মোদি ও পুতিনের মধ্য়ে হওয়া সামরিক সহ একাধিক দ্বিপাক্ষিক বিষয়বস্তুর ওপর জোর দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে এক-২০৩ ইস্যুটি উত্থাপন করা হয়। তখন থেকেই এই চুক্তির বাস্তব রূপ নেয়।

সম্প্রতি, এই রাইফেল কেনার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে ডিফেন্স অ্যাকুইশিসন কাউন্সিল (ডিএসি)। চুক্তি অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ একে-২০৩ রাইফেল কেনা হবে। প্রথম ৪০ হাজার ইউনিট রাশিয়া থেকে আমদানি করা হবে। প্রতিটি ইউনিটের দাম পড়বে আনুমানিক ৮০ হাজার টাকা। বাকিগুলি যৌথ উদ্যোগে ভারতেই তৈরি হবে। অমেঠির কোরবায় উঠে আসা অর্ডন্যান্সের নতুন কারখানায় উৎপাদন করা হবে বাকি ইউনিটগুলি।

এর জন্য ইতিমধ্য়েই ইন্দো-রাশিয়া রাইফেলস প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। জানা গিয়েছে, ওই সংস্থায় তিন অংশীদার রয়েছে। ভারতের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড (ওএফবি), কালাশনিকভ কনসার্ন ও রাশিয়ার সামরিক সরঞ্জাম রফতানি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা রসোবোরোনএক্সপোর্ট। এর মধ্যে ওএফবি-র অংশ ৫০.৫ শতাংশ, কালাশনিকভের ৪২ শতাংশ ও রসোবোরোনএক্সপোর্টের ৭.৫ শতাংশ।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভারতে তৈরি হলে ওই রাইফেলের দামও হবে কম। সূত্রের খবর, মোদি সরকার চাইছে ডিসেম্বরেই এই রাইফেলের উৎপাদন শুরু করে দিতে। ইতিমধ্য়েই অমেঠির কারখানা চালু হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীকালে, এই কারখানায় কালাশনিকভের অন্য সংস্করণ বা ভবিষ্যৎ মডেল উৎপাদনের সংস্থানও থাকছে। পাশাপাশি, চুক্তি মোতাবেক, ভারত অন্য দেশে এই অস্ত্র রফতানিও করতে পারবে বলেও জানা গিয়েছে।

ফলত, চুক্তি হওয়াটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। তেমনটা হলে, আগামী বছরই ভারতের হাতে চলে আসতে শুরু করবে কালাশনিকভ-২০৩। আদতে এই রাইফেল হল কিংবদন্তি একে-৪৭ রাইফেলের উত্তরসূরী। রুশ সেনা ব্যবহৃত একে-১২ রাইফেলের রফতানি নামকরণ হল একে-২০৩। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রাইফেল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ।