বেঙ্গালুরু: ভারতীয় বায়ুসেনার জন্য ৮৩টি তেজস মার্ক ১এ লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট (এলসিএ) তৈরির বরাত পেল হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)। বুধবার বেঙ্গালুরুতে এরো ইন্ডিয়া শো-র উদ্বোধনে এসে এই কথা ঘোষণা করেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ।
এদিন সরকারিভাবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৮৩টি যুদ্ধবিমান তৈরির বরাত হ্যাল চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর আর মাধবনের হাতে তুলে দেন প্রতিরক্ষামন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিকরা।
এর আগে, গত ১৩ জানুয়ারি, ১০টি প্রশিক্ষণ বিমান সহ ৮৩টি তেজস মার্ক-১এ ফাইটার জেট কেনার বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার কমিটি (সিসিএস)। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, শীর্ষ সামরিক কর্তারা।
এদিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, হ্যালের সাহস ও উদ্দীপনার জন্য এই বরাত তাদের হাতে তুলে দেওয়া হল। এর আগে, মঙ্গলবার বেঙ্গালুরুতে হ্যালের নতুন উৎপাদন কেন্দ্রের সূচনা করেন রাজনাথ।
হ্যালের সিএমডি জানিয়েছেন, প্রথম ব্যাচের তেজস মার্ক ১এ যুদ্ধবিমানগুলি ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুসেনার হাতে আসবে। আগামী ৬ বছরের মধ্যে ৮৩টি বিমানই তুলে দেওয়া হবে।
রাজনাথ সিংহ জানিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে এই বিমানগুলিই বায়ুসেনার মেরুদণ্ড হয়ে উঠবে। জানা গিয়েছে, বিমানগুলি দুটি ভেরিয়েন্টে আসবে। ৭৩টি তেজস-মার্ক ১এ সংস্করণের। বাকি ১০টি মার্ক-১ সংস্করণের-- যেগুলি প্রশিক্ষণ বিমান হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
বায়ুসেনার এক কর্তা জানান, বর্তমানে ভারতীয় বায়ুসেনার ফাইটার জেটের ৫০ শতাংশ দেশে তৈরি হয়। দুটি মূল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ -- বিমানের ইঞ্জিন ও রেডার যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েল থেকেই আমদানি করা হয়।
বর্তমানে, একটি বিমানে প্রায় ৩৪৪টি বিভিন্ন কম্পোনেন্ট (যন্ত্রপাতি) লাগানো থাকে। এরমধ্যে ২১০টি ভারতে তৈরি হয়। ১৩৪টি আমদানি করা হয়। হ্যালের লক্ষ্য, আমদানি হওয়া যন্ত্রের সংখ্যা কমিয়ে ৮০ করতে।
তেজস হল হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল) নির্মিত চতুর্থ-প্রজন্মের ফাইটার জেট। নিজ শ্রেণিতে এটিই হল বিশ্বের সবচেয়ে ছোট ও হাল্কা বিমান। ডেলটা উইংয়ের দৌলতে তেজস-এর ম্যানুভারাবিলিটি কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই নকশার ফলে, মাঝ-আকাশের লড়াইয়ে (ডগফাইট) দুরন্ত প্রমাণিত হয়েছে তেজস।
মূলত, এয়ার সুপিরিয়রিটি ফাইটার (অনেকটা সুখোই-৩০ এমকেআই বিমানের ধাঁচে) হলেও, ভূমি ও জাহাজ-বিধ্বংসী ভূমিকাও পালন করতে সক্ষম তেজস। এই বিমানে অত্যাধুনিক ফ্লাই-বাই-ওয়ার কন্ট্রোল সিস্টেম রয়েছে। এর ফলে, বিমান ম্যানুভারিংয়ে পাইলটের বেশি মনোনিবেশ করতে হয় না। বিমান তা অনেকটাই নিজের মতো করে নেয়। ফলত, শত্রুর ওপর বেশি মনোনিবেশ করতে সক্ষম হন পাইলট।
তেজস বিমানে একাধিক স্টেল্থ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ছোট আকার হওয়ায় তা শত্রুর রেডারে কম ধরা পড়ে। পাশাপাশি, তেজসের ৯৫ শতাংশ কম্পোসিট দিয়ে তৈরি, যার ফলে, রেডার সিগনেচার অত্যন্ত কম। এছাড়া, এর শরীরে যে পেইন্ট লাগানো, তাও রেডার-অ্যাবসরবেন্ট। অর্থাৎ, রেডার সিগনেচার প্রতিফলিত খুব কম হয়।
তেজস ফাইটার জেট মোট ৫,৩০০ কেজির অস্ত্র বহনে সক্ষম। এর ডানায় সাতটি হার্ডপয়েন্ট (অস্ত্র লাগানোর জায়গা) রয়েছে। এছাড়া, পৃথক রেকি (নজরদারি) পড, টার্গেট ডেজিগনেশন (লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করা) পড লাগানোর ব্যবস্থা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ জ্বালানি ট্যাঙ্কের পাশাপাশি, অধিক জ্বালানি বহনের জন্য তিনটে এক্সটার্নাল ফুয়েল পড বহনে সক্ষম এই বিমান। শুধু তাই নয়, মাঝ-আকাশে জ্বালানি ভরতেও সক্ষম এই বিমান।
বর্তমানে, উড়ানের প্রাথমিক অনুমতি পাওয়া ১৬টি তেজস মার্ক-১ বিমান অপারেট করছে ভারতীয় বায়ুসেনার ৪৫ নম্বর স্কোয়াড্রন (ফ্লাইং ড্যাগার্স)। এছাড়া, বাহিনীতে নতুন অন্তর্ভুক্ত হওয়া ১৮ নম্বর স্কোয়াড্রন (ফ্লাইং বুলেটস) অপারেট করছে তিনটি তেজস-মার্ক ১এস বিমান।
প্রসঙ্গত, তেজস মার্ক-১এ ভেরিয়েন্ট তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল উড়ানের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া তেজস মার্ক-১ ও অত্যাধুনিক মার্ক-২ সংস্করণের মধ্যবর্তী জায়গাকে ভরাট করতে। কেন্দ্রীয় সূত্রের খবর, ২০২৬ সাল নাগাদ আসতে পারে তেজস মার্ক-২ সংস্করণটি।
তেজস মার্ক-১এ বিমানে রয়েছে ১৫০ কিলোমিটার পাল্লা বিশিষ্ট ইজরায়েলি এলটা ২০৫২ AESA রেডার। এই রেডারের মূল কার্যকারিতা হল এয়ার সুপিরিয়রিটি, ভূমি ও নৌসেনার অত্যাধুনিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা। এই রেডারটি একসঙ্গে ৬৪টি লক্ষ্যবস্তুকে ট্র্যাক করতে সক্ষম, যা বর্তমানে চিনা ও পাকিস্তানি যুদ্ধবিমানের তুলনায় কয়েক কদম এগিয়ে।
একাধিক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত তেজস মার্ক-১এ যুদ্ধবিমান। বিশেষ করে, বিভিন্ন ধরনের অভিযানকে মাথায় রেখে এই ফাইটারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হরেক রকমের অস্ত্র। যেমন এয়ার সুপেরিয়রিটি মিশন (মাঝ-আকাশে বিমানের লড়াই) এতে রয়েছে সর্বাধুনিক রুশ নির্মিত আর-৭৭ বিভিআর (বিয়ন্ড ভিজুয়াল রেঞ্জ) ক্ষেপণাস্ত্র। এই মিসাইলের পাল্লা ১১০ কিমি।
এছাড়া রয়েছে ১০০ কিমি পাল্লার ইজরায়েলি ডার্বি ইআর মিসাইল, ৮০ কিমি পাল্লার স্বদেশীয় অস্ত্র মিসাইল। প্রসঙ্গত, বালাকোট অভিযানে এই অস্ত্র মিসাইল ব্যবহার করেছিল ভারতীয় বায়ুসেনা।
অন্যদিকে, আকাশ থেকে ভূমি অভিযানের জন্য এই বিমানে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে যে কোনও ইউরোপীয়, রুশ ও ভারতীয় লেজার-গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র। সেই তালিকায় রয়েছে ডিআরডিও নির্মিত এয়ারফিল্ড-বিধ্বংসী স(SAAW) ক্ষেপণাস্ত্র।
আবার নৌসেনার বিভিন্ন অভিযানে ব্যবহার করা যেতে পারে, ২৯০ কিমি পাল্লা বিশিষ্ট ব্রহ্মোস জাহাজ-বিধ্বংসী ক্রুজ মিসাইল। বলা হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্বে এটিই হল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জাহাজ-বিধ্বংসী মিসাইল।