গাঁধীর ঘাতকরা যেন আজ গোটা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে। দেশের সর্বোচ্চ সব অফিস থেকে সমস্ত আইন প্রণেতাদের অফিস। ভারতের সব শহরের অলি-গলি হোক বা মধ্যবিত্তের ঘরে-ঘরে। ভারতের বিভাজনের জন্য গাঁধীই দায়ী, মুসলমানদের তোষণ করতেন তিনি এই ভাবনাগুলে যারা পোষণ করেন, তাদের সবাই যেন গাঁধীর অহিংস ভাবমূর্তিকে হত্যা করেছেন।


হ্যাঁ, আজকের দিনটা বিশেষ। ঠাণ্ডাঘর থেকে ‘জাতীর জনক’কে বের করে তাঁর উদ্দেশ্যে একাধিক সম্মানপ্রদর্শন করা হয়েছে। গাঁধীকে নিয়ে কার্যকলাপ মনে করিয়ে দেয় সেই প্রখ্যাত কথন, নিজের দেশ ছাড়া গুণিজন সর্বত্র পুজিত। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে প্রাণ হারিয়েছিলেন গাঁধী, তারপর থেকে দিনটা শুধুমাত্র রাজনীতিবিদদের দুই মিনিটের নীরবতা পালনের দিন হিসেবে থেকে গিয়েছে। সরকারিভাবে অবশ্যই দিনটা ‘শহিদ দিবস’, তাই রাজঘাটে গিয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে স্মৃতিপ্রদর্শনও করা হয়, কিন্ত তারপরই সরকার দ্রুত ফিরে যায় বিরুদ্ধ কন্ঠস্বর রোধ করতে, সমাজকর্মীদের জেলে ভরতে।

সম্প্রতি গত কয়েকবছর ধরে ভারতজুড়ে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যেখানে গাঁধীর প্রতি অবমাননা বৃদ্ধিই নয়, সঙ্গে সঙ্গী হয়েছে গাঁধীর হত্যাকাকী নাথুরাম গডসেকে গৌরবাণ্বিত করে দেখানোর কাজ। দু শতক আগে যে মাটিতে লেখা মহাভারতের স্রোত ‘অহিংস পরম ধর্ম’ এখন সত্যিই সুদূর ভাবনা। সপ্তাহ দুয়েক আগের ঘটনাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দেয়।

দেশের রাজধানী দিল্লি থেকে মাত্র ২০০ মাইল দূরে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিওর শহরে উন্মোচিত হয়েছে গডসে জ্ঞান শালা। বিপ্লবী গডসে সম্পর্কে জনসাধারণের ‘জ্ঞান’ বাড়াতেই নাকি যে প্রক্রিয়া। যে ব্যক্তিককে ১৯৪৯ সালে চড়ানো হয়েছিল ফাঁসিতে। গাঁধী হত্যার চক্রান্তে যুক্ত থাকায় ১৯৬৪ সালে যার ভাই গোপাল গডসে ও বিষ্ণু কারকারেকে পাঠানো হয়েছিল যাবৎজীবন কারাবাসে। যখন তারা ছাড়া পান সেই অনুষ্ঠান উদযাপনে হাজির ছিলেন প্রায় ২০০ জন। তাঁরা নাথুরাম গডসেকে তকমা দিয়েছিলেন ‘দেশভক্ত’ হওয়ার, যে ঘটনা সামনে আসার পর ঝড় উঠেছিল ভারতীয় সংসদে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদের তথাকথিত জাগরণ ফের হয় গত শতাব্দীর আশির দশকে।  বাড়তে শুরু করে গডসের পক্ষধারীদের সংখ্যা। আর সাত বছর আগে ভারতবর্ষে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সংখ্যাটা ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করে।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে বর্তমান দেশের শাসকদলের সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুর সর্বসমক্ষে বলেছিলেন, ‘নাথুরাম গডসে দেশভক্ত থে, হ্যা ওর রহেঙ্গে।’ (নাথুরাম গডসে দেশভক্ত ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।) ভোপাল থেকে লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন তিনি, যার বিরুদ্ধে নাশকতায় যুক্ত থাকার অভিযোগ থাকায় তিনি জেলও খেটেছেন।

গাঁধীর হত্যাকারীকে গৌরবাণ্বিত করে দেখানোটা ভারতে রাজনৈতিক সাফল্যপ্রাপ্তি ছাড়পত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোয়ালিওরের গডসে লাইব্রেরিই যার পরিচয়। অন্যদিকে, গডসেকে নিয়ে মন্তব্যের পর একলাফে কয়েকগুণ বাড়ে প্রজ্ঞা ঠাকুরের সোশ্যাল মিডিয়ায় ফলোয়ারের সংখ্যা।

গাঁধীর হত্যাকারীদের সংখ্যাবৃদ্ধি শুধু নয়, বর্তমানে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিত দেখলে হয়তো আরও ভালো করে বোঝা যাবে ‘জাতির জনক’-র অহিংস পথ যেন বিস্মৃতপ্রায়। আধুনিক ভারতের ইতিহাসই যেন কার্যত মুছে গিয়েছে ভারতবাসীর অভিধান থেকে। বর্তমানে দেশবাসীর চালচলনে অহিংস পথ আর যেন গ্রহণযোগ্যই নয়। হিংসার রেশ যেন গোটা দেশজুড়ে।

হিংসার পথ বর্তমান যুগে বয়ে এসেছে সমাজমাধ্যমেও। সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক ট্রোলিংই কার্যত প্রচণ্ড আগ্রাসী-হিংসাত্মক চেহারায় ধরা যায়। শালীনতার মাত্রাবজায় রাখার দায়ও যেন কারোর নেই। একদল যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় হিংসা ছড়ানোর কাজ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সবমিলিয়ে হিংসাত্মক আবহ যেন সর্বত বহমান।

জীবৎকালে গাঁধীর ব্যক্তিত্বের ব্যপ্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ঘনিষ্ট মহলে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘ভারতই গাঁধী’। অহিংস প্রতিরোধের হাত ধরেই ভারতের যে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ইতিহাস তা শুধু বিস্মৃতপ্রায়ই নয় বর্তমান ভারতে যেন অহিংস পথধারণ কাপুরুষতার পরিচয়।

তবে গাঁধীর দেখানো পথ যে এখনও ভারতবাসী একেবারে ভোলেনি, সেইসব ছবিও কিন্তু উজ্জ্বল। তাই তো নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাজধানীর ঠান্ডাতেও রাতের পর রাত জাগেন একাধিক ব্যক্তি। ২০১৯ সালে অহিংস প্রতিরোধের যে ছবি শাহিনবাগে দেখেছিল ভারতবাসী, শাহিনবাগের সেই অহিংস আন্দোলন সরকারকে থামাতে সাহায্য করেছিল করোনা ভাইরাস রুখতে জারি করা লকডাউনের রেশ।

সম্প্রতি ফের যেন কৃষক আন্দোলনে ধরা পড়েছে সেই অহিংস প্রতিরোধের ছবিই। যেভাবে ভারতবর্ষজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে হিংসার রেশ, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে গাঁধীর অহিংস পথ ধরাই হয়তো পথ দেখাবে। ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে ভারত, অহিংস পথ না ধরলে হয়তো আরও বড় শঙ্কাই আগামীদিনের জন্য অপেক্ষা করছে।

(বিনয় লাল- লেখক, ব্লগার, সাংস্কৃতিক পর্যালোচক ও ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক )

(বিধিসম্মত সতর্কীকরণ- লেখাটিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। যে মতামতের সঙ্গে এবিপি আনন্দের কোনও সম্পর্ক নেই।)