নয়াদিল্লি: সাহসী, শক্তিশালী, ক্ষিপ্র। আর পাঁচজনের মতো নন। ইনি হলেন ডঃ সীমা রাও। ভারতের একমাত্র মহিলা কম্যান্ডো প্রশিক্ষক, যাঁর হাত ধরে বিগত ২০ বছরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পেয়েছে বহু স্পেশাল ফোর্সের বীর কম্যান্ডো।


এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক সীমার প্রতিভা সামরিক মার্শাল আর্টসে সেভেন্থ ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্টের অধিধারী সীমা। তিনি কমব্যাট শ্যুটিং ইন্সট্রাক্টর, ফায়ার-ফাইটার, স্কুবা ডাইভার, অভিজ্ঞ পর্বতারোহী। তিনি একজন চিকিৎসক এবং এমবিএ ডিগ্রিধারী। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট (এইচএমআই) থেকে সীমা রক-ক্লাইম্বিংয়ে পদক জিতেছেন।

এখানেই শেষ নয়। সীমা একজন লেখিকা। তিনি অন্তত ৬টি বই লিখেছেন। যার অধিকাংশই কম্যান্ডো প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত বা কম্যান্ডো অভিযান নিয়ে। এত কিছুর আগে শুনলে অবাক হতে হবে সীমা একজন প্রাক্তন সফল মডেল-ও ছিলেন। তিনি মিস ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড পেজেন্টে ফাইনালিস্ট!

সীমা হলেন বিশ্বের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যাঁরা বিরল মার্শাল আর্টস ‘জীত কুনে ডো’-তে সিদ্ধহস্ত। শুধু তাই নয়, অন্যদের এই বিশেষ ধরনের মার্শাল আর্টসের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতিও তিনি লাভ করেছেন। ‘জীত কুনে ডো’ হল একটি বিশেষ মিশ্র এবং সারগ্রাহী ঘরানার মার্শাল আর্ট। ১৯৬৭ সালে ব্রুস লি এই ঘরানা তৈরি করেছিলেন। লি-র ছাত্র রিচার্ড বুস্টিলোর থেকে এই ঘরানা রপ্ত করেছেন তিনি।



জানা গিয়েছে, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে এমন কোনও কম্যান্ডো ফোর্স নেই, যাঁদের প্রশিক্ষণ দেন নি সীমা। সেই তালিকায় রয়েছে – সেনার প্যারা স্পেশাল ফোর্সের কম্যান্ডো উইং,  নৌসেনার মার্কোস মেরিন কম্যান্ডো, বায়ুসেনার গরুড় কম্যান্ডো, এনএসজি ব্ল্যাক ক্যাট। এছাড়া, আইটিবিপি সহ বিভিন্ন আধা-সামরিক বাহিনী, প্রায় ১৬ রাজ্যের পুলিশ ফোর্স, কোর ব্যাটল স্কুল এবং অ্যাকাডেমিতেও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সীমা। এছাড়া, নিজেদের আনআর্মড অ্যান্ড কম্যান্ডো কমব্যাট অ্যাকাডেমি (ইউসিসিএ) খুলেছেন এই বীর নারী।

কী করে এতকিছু সামলান সীমা? নিজেই জানালেন, প্রথমে তিনি চিকিৎসকই ছিলেন। তারপর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের ওপর এমবিএ করেন। মার্শাল আর্টসের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাঁর স্বামী মেজর দীপক রাও। সীমার বাবা রমাকান্ত সিনারি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাই বড় হয়ে দেশসেবার প্রতি উদ্বুদ্ধ হন সীমা। স্বামীর অনুপ্রেরণায় তিনিও যোগ দেন সেনাতে।

বিগত ২ দশক ধরে এই দম্পতি সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের প্রশিক্ষক রয়েছেন। তাঁদের বিশেষত্ব হল ক্লোজ-কোয়ার্টার ব্যাটল (সিকিউবি) বা হাতাহাতি যুদ্ধ। এখানে অস্ত্র ছাড়া বা অস্ত্র সহ লড়াই হয়। এরজন্য চাই মারাত্মক শারীরিক ক্ষিপ্রতা, দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতির বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

এক কথায়, একজন কম্যান্ডোকে যা যা শিখতে হয়, সবকিছুরই প্রশিক্ষণ দেন সীমা-দীপক। সীমা জানান, সিকিউবি-তে অত্যন্ত পারদর্শী দীপক। সেনাবাহিনীতে ২০ বছর ধরে অবদানের জন্য ২০১১ সালে বিশেষ রাষ্ট্রপতি সম্মান পান দীপক।



তবে, তাঁদের এই কৃতিত্বের নেপথ্যে অনেক বলিদানও আছে। ঝরেছে অনেক রক্ত। সীমা-দীপককেও কঠিন সময় দিয়ে যেতে হয়েছে। একবার শিরদাঁড়ায় চিড় ধরা পড়ে সীমার। আরেকবার, জঙ্গিদের গুলির নিশানা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, কখনই তা সীমাকে তাঁর ডিউটি থেকে সরাতে পারেনি। ডিউটির খাতিরে নিজের বাবার শেষকৃত্যে যোগ দিতে পারেননি।

সীমা নিজে জানান, তাঁকে রাজস্থান থেকে লাদাখ, সীমান্ত থেকে জঙ্গল—সর্বত্র ডিউটি করতে হয়েছে নিরলসভাবে। একবার এক দুর্ঘটনায় তাঁর মস্তিষ্কে এমন চোট লাগে যে কিছুদিনের জন্য স্মৃতিলোপ পেয়েছিল। এমনকী, নিজের স্বামীকেও চিনতে পারছিলেন না। পরবর্তীকালে, তা স্বাভাবিক হয়। এসব কারণে, সন্তান ধারন না করার সিদ্ধান্ত নেন সীমা। অবশ্য, নিঃসন্তান নন তাঁরা। একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে দত্তক নেন রাও-দম্পতি। বিগত ১৮ বছর ধরে সেই কন্যা তাঁদের সঙ্গেই রয়েছেন।

এই বীর নারীকে স্যালুট!!