কলকাতা: বিশ শতকের শুরুতে বাংলার উত্থানে স্বামী বিবেকানন্দ উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর সব থেকে কার্যকরী অস্ত্র ভগিনী নিবেদিতাকে। নিবেদিতা তাঁর দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম-এ লিখেছেন, স্বামীজি বলেছিলেন, দুর্বলের ওপর কেউ অত্যাচার করছে দেখলে আমাদের উচিত, অত্যাচারীকে উত্তম মধ্যম দেওয়া। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার তোমার সব সময় আছে। সাহসী হওয়া ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা- স্বামীজির যাবতীয় উপদেশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এই দুটি বাণীকে মুখ্য করে। ভারতীয় তরুণ সমাজের মধ্যে এই সাহসিকতার বাণী প্রোথিত করার উদ্দেশে নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করে দেন ৩৯ বছরে প্রয়াত সন্ন্যাসী।

উনিশ শতকের বাংলায় রামমোহন, বিদ্যাসাগররা নবজাগরণ এনেছিলেন ঠিকই কিন্তু তাকে ধরে রাখার মত আধার কই। ইংরেজের শোষণ নীতি ছিবড়ে করে দিয়েছে বাঙালিকে, তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মেকলের চুঁইয়ে পড়া শিক্ষানীতি। অনশন, অর্ধাশনে বাঙালি তখন বিপর্যস্ত, নিজের জমি, অস্তিত্বটুকুর জন্য লড়াই করার ক্ষমতাও নেই। সে সময় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, হায় লাঠি, তোমার দিন গিয়াছে। আর স্বামীজি এসে বাঙালিকে বোঝালেন, শরীর মন যদি শক্ত না হয় তবে বীরভোগ্যা স্বাধীনতা অর্জন করা অসম্ভব। যে দেশের সন্ন্যাসীরা বরাবর মানুষকে মোক্ষচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেই দেশেই দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘তোমরা সবল হও- তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমার স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে’। আরও বললেন, ‘জীবনের পরম সত্য এই- শক্তিই জীবন, দুর্বলতাই মৃত্যু। শক্তিই সুখ ও আনন্দ, শক্তিই অনন্ত ও অবিনশ্বর জীবন; দুর্বলতাই অবিরাম দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ; দুর্বলতাই মৃত্যু’।

কীভাবে আসবে বহু প্রতীক্ষিত সাফল্য? স্বামীজি বলেছেন, ‘সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রবল অধ্যবসায়, প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি থাকা চাই। অধ্যবসায়শীল সাধক বলেন, আমি গণ্ডুষে সমুদ্র পান করিব। আমার ইচ্ছামাত্রে পর্বত চূর্ণ হইয়া যাইবে। এইরূপ তেজ, এইরূপ সঙ্কল্প আশ্রয় করিয়া খুব দৃঢ়ভাবে সাধন কর। নিশ্চয়ই লক্ষ্যে উপনীত হইবে’।

‘কেবল খাইয়া পরিয়া মূর্খের মতো জীবন-যাপন অপেক্ষা মৃত্যুও শ্রেয়ঃ; পরাজয়ের জীবন-যাপন অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে মরা শ্রেয়ঃ’।

তাঁর প্রয়াণের পর ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে যুবকরা গোটা দেশে ইংরেজের ভিত কাঁপিয়ে দেবে, তাদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘নিরাশ হইও না; পথ বড় কঠিন—যেন ক্ষুরধারের ন্যায় দুর্গম; তাহা হইলেও নিরাশ হইও না; উঠ—জাগো এবং তোমাদের চরম আদর্শে উপনীত হও’।

গোটা দেশকে আত্মবিশ্বাসের মন্ত্র দেওয়া সন্ন্যাসী বলেন, ‘প্রথমে আপনাকে বিশ্বাস কর দিকি। নিজের উপর বিশ্বাস রাখ, সমুদয় শক্তি তোমার ভিতরে—এইটি জান এবং ঐ শক্তি অভিব্যক্ত কর’।

এমন এক ভাষায় তিনি কথা বললেন, যা জড়তায় নিমজ্জিত ভারত দীর্ঘদিন ভুলে গিয়েছিল। তিনি বললেন, ‘পাপ করে কাপুরুষরা। বীর পাপ করে না, পাপচিন্তা মনে আসতেও দেয় না। সম্পূর্ণ নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও— প্রাণের ভয় পর্যন্ত রাখিও না। ধর্মের মতামত লইয়া মাথা বকাইও না। ... সকলকে গিয়ে বল—ওঠ, জাগো, আর ঘুমিও না; সকল অভাব, সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের নিজের ভিতর রয়েছে, এ কথা বিশ্বাস কর, তাহলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে। সিংহ-গর্জনে আত্মার মহিমা ঘোষণা কর, জীবকে অভয় দিয়ে বল—‘উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’—Arise! Awake! and stop not till the goal is reached (ওঠ, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থামিও না)’।

তাঁর বাণীমাত্র সম্বল করে যাঁরা গভীর রাতে প্রাণের মশাল জ্বালিয়ে ক্ষুরধার পথ ধরে হেঁটেছিলেন, অগ্নিযুগের সেই পথিকদের তিনি বলেছিলেন, ‘ওঠ, সাহসী হও, বীর্যবান হও। সব দায়িত্ব নিজের উপর গ্রহণ কর—জানিয়া রাখ, তুমিই তোমার অদৃষ্টের সৃষ্টিকর্তা। তুমি যে শক্তি বা সহায়তা চাও, তাহা তোমার ভিতরেই রহিয়াছে’।

প্রয়াণের কিছুদিন আগে পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন স্বামীজি। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন সদ্য তরুণ হেমচন্দ্র ঘোষ, যিনি পরে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের মত বিপ্লবী সংগঠন গড়বেন, যেখান থেকে উঠে আসবেন বিনয় বাদল দীনেশরা, সেই হেমচন্দ্রকে স্বামীজি বলেন, পরাধীন জাতির কোনও ধর্ম নেই। তোদের একমাত্র ধর্ম হচ্ছে মানুষের শক্তি লাভ করে আগে পরস্বাপহারীদের দেশ থেকে তাড়ানো। তারপর আমার কাছে আসিস ধর্মের কথা শুনতে।

‘বিশ্বাস, বিশ্বাস, সহানুভূতি, অগ্নিময় বিশ্বাস, অগ্নিময় সহানুভূতি।... তুচ্ছ জীবন, তুচ্ছ ক্ষুধা, তুচ্ছ শীত। ...অগ্রসর হও। ...পশ্চাতে চাহিও না। কে পড়িল দেখিতে যাইও না। এগিয়ে যাও—সম্মুখে। এইরূপেই আমরা অগ্রগামী হইব—একজন পড়িবে, আর একজন তাহার স্থান অধিকার করিবে’।

তাঁর আহ্বানে নিজেদের প্রাণ বাজি রেখে যাঁরা মৃত্যুরূপা মাতাকে বরণ করে নিয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিনেই তাঁদের কয়েকজনের প্রয়াণ দিবস। ১৯৩৩ সালের আজকের দিনে প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের ফাঁসি হয়। এর ঠিক এক বছর পর এই দিনে ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেন মাস্টারদা সূর্য সেন। স্বামীজি তাঁদের মধ্যে যে আগুন জ্বালিয়েছিলেন তার চির প্রণম্য শিখা এভাবেই তার দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।