অরিত্রিক ভট্টাচার্য, পার্থপ্রতিম ঘোষ, বালেশ্বর : দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সমস্ত কামরাই ছিল আধুনিক এবং নিরাপদ এইচএলবি কোচ। দাবি রেলমন্ত্রীর। তার পরেও এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হল কী করে ? প্রশ্ন উঠছে। রেলের অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস 'কবচ' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধীর চৌধুরী।
"যে ক্ষমতাশালী এলএইচবি কোচ তৈরি করা হচ্ছে এবং সমস্ত পুরানো কোচগুলিকে শীঘ্রই এলএইচবি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। পরিকাঠামোর উন্নতিতে ১ লক্ষ ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।" গত বছর বাজেট পেশের দিন সাংবাদিক বৈঠকে জলপাইগুড়ি দোমোহনিতে ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। আর বাজেট প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ শুনিয়েছিলেন রেলের 'কবচ' প্রকল্পের কথা। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, "আত্মনির্ভর ভারত-এর অংশ হিসাবে, ২ হাজার কিলোমিটার নেটওয়ার্ককে 'কবচ'-এর আওতায় আনা হবে। এই প্রযুক্তি নিরাপত্তা ও ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য দেশীয় পদ্ধতিতে তৈরি বিশ্বমানের প্রযুক্তি।"
কিন্তু সব আশ্বাসই সার ! তার পরেও এড়ানো গেল না ভয়াবহ দুর্ঘটনা ! শুক্রবার বালেশ্বরের কাছে বাহানাগা বাজারে লাইনচ্যুত হয় চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ১৫টি বগি। একই সঙ্গে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেস এবং একটি মালগাড়ি। এক ঝলকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কোন কামরা কোন ট্রেনের ! দুর্ঘটনার অভিঘাতে দুমড়ে মুচড়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের একের পর এক বগি। এমনকী, কম ক্ষতিগ্রস্ত কামরার ছবি দেখলেও শিউরে উঠতে হয়।
যদিও ঘটনাস্থলে গিয়ে রেলমন্ত্রী দাবি করেছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে আধুনিক এবং নিরাপদ এইচএলবি কোচ ব্যবহার করা হয়েছিল। তা হলে এমন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা দেখতে হল কেন ? প্রশ্ন উঠছে, রেলমন্ত্রীর LHB কোচের দাবি নিয়ে।
২০০০ সাল থেকেই এই LHB কামরা ব্যবহার করছে ভারতীয় রেল ৷ কী এই LHB কোচ ? পুরো নাম, লিঙ্ক হফম্যান বুশ কোচ।
এই কামরার প্রধান বৈশিষ্ট্য, ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে এটি উল্টে যায় না ৷ দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে সাধারণ কামরা সজোরে ছিটকে পড়ে এবং উল্টে যায়। কিন্তু, জার্মান প্রযুক্তিতে তৈরি LHB কামরার ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা নেই বললেই চলে ৷ এর সঙ্গে থাকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি নিউম্যাটিক ব্রেক। যার মাধ্যমে ট্রেন তীব্র গতিতে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হলেও, আচমকা গতিবেগ কমে যাওয়াকে অনেকটাই সামাল দেওয়া যায়। রেলমন্ত্রীর দাবি সত্যি হলে, কীভাবে এমন অবস্থা হল করমণ্ডলের কোচগুলির ?
করমণ্ডল-কাণ্ডের পর প্রশ্নচিহ্ন বসে গিয়েছে রেলের 'কবচ' প্রকল্পের পাশেও। বর্তমান রেলমন্ত্রীকে পাশে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী। প্রসঙ্গত, ‘কবচ’ হল ACD অর্থাত্ অ্যান্টি কলিশন ডিভাইস ৷ এর মাধ্যমে এক লাইনে দু’টি ট্রেনের সংঘর্ষ এড়ানো যায়।
রেডিও কমিউনিকেশন, মাইক্রোপ্রসেসর এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা GPS প্রযুক্তির ভিত্তিতে কাজ করে 'কবচ'। তিনটি অংশে বিভক্ত এই যন্ত্রটির প্রধান অংশ অন্য অংশটিকে জানান দেয়, সেই লাইনে অন্য কোনও ট্রেন সেই মুহূর্তে আছে কি না ৷ দু’টি ট্রেন একই লাইনে চলে এলে এবং তাদের মধ্যে দূরত্ব কমে এলে ইঞ্জিনে বসানো যন্ত্রের মাধ্যমে সিগন্যাল দিতে থাকে ‘কবচ’। যা চালকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তিনি। শুধুমাত্র, সামনে থেকে সংঘর্ষ এড়ানোই নয়, ACD থাকলে পিছন থেকেও কোনও ট্রেন ওই লাইনে এসে পড়লেও নির্দিষ্ট দূরত্বে থমকে যাবে পিছনের ট্রেন ৷
২০১৪ সালে প্রথম এই প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হয়। ২০২০ সালে ‘কবচ’কে জাতীয় স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনগুলিতে সেই সুরক্ষাকবচ ছিল কি ? প্রশ্ন উঠছে। বিভিন্ন রুটে ট্রেনের গতি বাড়ছে। ছুটছে সেমি হাইস্পিড ট্রেন। চলবে বুলেট ট্রেনও। তাদের থেকে অনেক কম গতিতে ছোটা করমণ্ডল এক্সপ্রেসের এই অবস্থা হলে, ভবিষ্যতে কী হবে ! আর কবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত হবে যাত্রীদের নিরাপত্তা ?