মস্কো: পড়শি দেশ ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করেছিলেন যেদিন, সেই দিন থেকেই প্রহর গোনা শুরু করেছিল ইউরোপ তথা পশ্চিমি বিশ্ব। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের (Vladimir Putin) পতন অনিবার্য বলে বলে ধরে নিয়েছিলেন তাঁরা। যুদ্ধ বিরোধী সাধারণ রুশ নাগরিকই প্রতিবাদে সরব হবেন বলে আশাবাদী ছিলেন তাঁরা। বিগত একবছরের বেশি সময় কেটে গেলেও, তেমন কিছু ঘটেনি রাশিয়ায় (Russia Crisis)। তবে শনিবার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়, যখন পুতিনের একদা ঘনিষ্ঠ, ভাড়াটে যোদ্ধা সংগঠন PMC Wagner-এর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন মস্কোর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লব এবং অভ্যুত্থানের ডাক দেন। কিন্তু মাত্র একদিনেই সেই বিপ্লবের প্রশমন এবং রাতেই ইয়েভগেনির নির্বাসন, আরও একবার পশ্চিমি বিশ্বের সেই আশায় কার্যত জল ঢেলে দিল। বরং মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে ফের একবার তিনি নিজের শক্তির পরিচয় দিলেন বলে মনে করছেন কূটনীতিকদের একাংশ। একই সঙ্গে এই পরিস্থিতি পুতিনের দুর্বলতাও প্রকাশ করে দিল বলে মনে করছেন অনেকে।


বিগত দু'দশকেরও বেশি সময় ধরে যেখানে রাশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য পুতিনের, এমন পরিস্থিতি মাথাচাড়া দিল কী করে, তা নিয়ে যদিও প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। কিন্তু একবছরের বেশি সময় ধরে অব্যাহত যুদ্ধ পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার কথা ধরলে, যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গেই পুতিন পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন বলা যায়। কারণ তিনি পলায়নে উদ্যত, গা ঢাক দিয়েছেন বলে যখন গেল গেল রব উঠছে চারিদিকে, সেই সময় জতির উদ্দেশে ভাষণে পুতিন জানিয়ে দেন, মস্কো ছেড়ে নড়েননি তিনি। সুর নরম করার পরিবর্তে বিদ্রোহীদের কড়া বার্তা দিতেও শোনা যায় তাঁকে। একদা ঘনিষ্ঠ ইয়েভগেনিকে সরাসরি 'বিশ্বাসঘাতক' বলে উল্লেখ করেন। যে বা যাঁরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, মস্কোর দিকে এগোচ্ছেন, তাঁদের কঠিনতর শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়ে দেন। 


আরও পড়ুন: Russia Crisis: শেষ মুহূর্তে বন্ধু লুকাশেঙ্কো সহায় হলেন পুতিনের, বিদ্রোহীদের শাস্তি দিতে পারবে না রাশিয়া, কোনও রকমে আটকানো গেল গৃহযুদ্ধ


রাশিয়া থেকে যখন মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে সশস্ত্র ভাড়াটে যোদ্ধাবাহিনী, সেই সময় আমেরিকার পেন্টাগনের প্রাক্তন আধিকারিক এভলিন ফারকাস বলেন, "আমেরিকার জন্য় অবশ্যই রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি। কারণ রাশিয়ার মানুষ এখন বিভ্রান্ত। ফলে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়বে। তার প্রভাব পড়বে অন্যত্রও। সিরিয়ার মতো পশ্চিম এশিয়াতেও রুশ বাহিনী সমস্যায় পড়বে।  কিন্তু পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র রাশিয়ার পেশাদার, সরকারি সশস্ত্রবাহিনী কতটা সক্রিয়, কোন উপায়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে তারা, তা-ই উদ্বেগে রেখেছে সকলকে।"


এর আগে, ১৯৯১ সালের অগাস্ট মাসে, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক মিখাইল গর্বাচেভের বিরুদ্ধেও অভ্য়ুত্থান ঘটে। সেটিও ব্যর্থ হয় যদিও। তার পর পদ থেকে ইস্তফা দেন গর্বচেভ।১৯৯৩ সালে আবার বরিস ইয়েলৎসিন এবং সংসদের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দেয়। সেই সময় যদিও পক্ষ বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল আমেরিকার কাছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি, পুতিনও রাশিয়ার মিত্র নন, ইয়েভগেনি তো ননই। তাই রাশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে কোনও মন্তব্যেই যাননি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকার আশঙ্কা ছিল, এই পরিস্থিতিতে কোনও প্রতিক্রিয়া জানালে, ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব তুলে ধরবেন পুতিন। বরং ওই সময়ে হোয়াইট হাউস থেকে পরিস্থিতির দিকে নজর ছিল বাইডেনের। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সঙ্গে তাঁর কথাও হয় বলে খবর।


শুধু তাই নয়, রাশিয়া থেকে খবর পেতেও আমেরিকাকে হিমশিম খেতে হয় বলে খবর। অশান্তির আঁচ পেয়েই মস্কো থেকে যান চলাচল, ইন্টারনেট পরিষেবা, ডিজিটাল মাধ্যমে খবরের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। ফলে সোশ্যাল মিডিয়ার ভরসায় বসে থাকতে হয় আমেরিকাকে, বাস্তব পরিস্থিতি জানার জন্য় যা ভরসাযোগ্য বলে ধরা হয় না। অশান্তির পরিস্থিতিতে রাশিয়ার অস্ত্রভাণ্ডার সরানো হচ্ছে কিনা, পরমাণু কেন্দ্রগুলিতে কোনও সক্রিয়তা চোখে পড়ছে কিনা, কড়া নজর ছিল আমেরিকার। অশান্তি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করলে, কয়েক দিন ধরে অচলাবস্থা চললে, কী অবস্থান নেওয়া হবে, তা নিয়ে পরিকল্পনা চলছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সব থিতিয়ে যায়। আমেরিকা কিছু করতে গেলে রাশিয়ার তরফে কী প্রতিক্রিয়া মিলতে পারে, তা নিয়েও ছিল আশঙ্কা। 


গত কয়েক মাস ধরে রুশ সরকারের সঙ্গে ইয়েভগেনির সংঘাত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিল আমেরিকা। কিন্তু যে প্রশ্নটি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল সকলকে, তা হল, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জমি আলগা হতে দেখে পুতিন নিজের জমি মজবুত করতেই এই বিদ্রোহের পরিকল্পনা রচনা করেননি তো!  শনিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে ১৯১৭-র প্রসঙ্গ টানেন পুতিন, যে সময় যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ার জ়ার সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, যা দেখে শাসক পুতিনের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ বেরিয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নেন অনেকেই। ভাষণে ইয়েভগেনিকে হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরই আবার তাঁর সঙ্গে সমঝোতা করার সিদ্ধান্তও অনেকের চোখে পুতিনকে দুর্বল হয়ে পড়া শাসক হিসেবে তুলে ধরেছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন পুতিনের চেয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়া পুতিন আরও আগ্রাসী বলে মত কূটনীতিকদের। সেক্ষেত্রে রুশ নাগরিকদের সমবেদনাও মিলবে। এ ছাড়া পুতিনের বিকল্প হিসেবে রুশরা ইয়েভগেনিকে কখনওই বেছে নেবেন না বলেও মত তাঁদের।


ন্যাটে-র (NATO) প্রাক্তন দূত কার্ট ভল্কারের মতে ইয়েভগেনি অত্যন্ত ধূর্ত। নিজেকে রুশদের সামনে নায়ক করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। তার বিনিময়ে নিজের দাবিদাওয়া পূরণ করে নেওয়াই লক্ষ্য ছিল তাঁর। গোপন সমঝোতায় কী কথা হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই মুহূর্তে বেলারুসে নির্বাসন কাটাতে গেলেও, পুতিন এত সহজে তাঁর ছেড়ে দেবেন বলে মনে করছেন না কূটনীতিকদের কেউই।