দীপক ঘোষ, কলকাতা: তিন দিনের বাজেট অধিবেশনের মধ্যে দিয়ে শেষ হল ১৬তম বিধানসভার মেয়াদ। প্রতিবার ভোটের বছর পূর্ণাঙ্গ বাজেটের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ হয়। যা ভোট অন অ্যাকাউন্ট নামেই পরিচিত। অন্তর্বর্তী বাজেটে নতুন আর্থিক বছরের প্রথম তিনমাসের জন্য সরকারি খরচ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ অনুমোদন করা হয়। নতুন নির্বাচিত সরকার বিধানসভায় এসে তৈরি করবে বাকি ৯ মাসের পূর্ণাঙ্গ বাজেট। এবার বাজেট অধিবেশন হলেও এবারই প্রথম সেই বাজেট অধিবেশনে দেখা গেল না রাজ্যপালকে। তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন অন্তর্বর্তী বাজেট পেশের সময় হাজির ছিলেন না বিরোধী দল নেতা আব্দুল মান্নান। কংগ্রেস এবং সিপিএম মিলে অধিবেশন বয়কট করায়, ছিলেন শুধু বিজেপির জনা কয়েক বিধায়ক। তারা প্রতিবাদ করলেন , বিক্ষোভ করলেন এবং পরে বয়কটও করলেন। শুক্রবার শুরু হয়েছিল বিধানসভা আর শেষ হল সোমবার।


শেষ দিন যত বিধায়ক উপস্থিত ছিলেন, প্রথা মেনে তাদের গ্রুপ ফটো তোলা হয়। ফটো সেশন শেষ করে বেরিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাওয়ার সময় হাতের মুদ্রায় ‘ভি’ দেখিয়ে বলে গেলেন 'আবার আসছি'। কে হবে পরবর্তী সরকার? চুলচেরা বিশ্লেষণে মত্ত গোটা দেশের রাজনৈতিক মহল। লড়াই এতটাই হাড্ডাহাড্ডি, যে অতি বড় রাজনৈতিক জ্যোতিষীর পক্ষেও হলফ করে কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। রাজনীতির এই বাউন্সি পিচে ম্যাচের ফল জানতে শেষ বল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।


কিন্তু অপেক্ষা না করেই যে ভবিষ্যদ্বাণী এখনই নির্দ্বিধায় করা যায়, সেটা হল বিধানসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে পরিবর্তন ঘটতে চলেছে এবার। ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্র যে ধাঁচে গড়ে উঠেছে সেটাকেই অনুকরণ করা হয়েছে ভারতে। ব্রিটেনে সংসদীয় গণতন্ত্রের এই মডেলকে বলা হয় ওয়েস্টমিনিস্টার মডেল। সেই আদর্শ সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্যের বা দেশের প্রশাসনিক প্রধান অবশ্যই আইনসভার একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।  কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় বিরোধী দল নেতার পদটিকে। ব্রিটেনে বিরোধী দলনেতাকে বলা হয় ছায়া প্রধানমন্ত্রী। আমাদের দেশেও বিরোধী দলনেতাকে ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে বলা হয়, ‘পার্লামেন্ট বিলংস টু অপজিশন’। সাদা বাংলায়, সংসদ বিরোধীদের। সরকার একমাত্র এই বিধানসভাতেই বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য।


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা গঠিত হওয়ার আগে এই বিধানসভা ছিল অবিভক্ত বাংলার "বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভা"।  প্রশাসনিক প্রধান পদে মুখ্যমন্ত্রী নয়, ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন ভারতে খণ্ডিত বাংলায় যাত্রা শুরু করে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা। আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৫৭ সালে তৈরি হয় বিধানসভার বিরোধী দল নেতার পদ। বিধান রায় তখন মুখ্যমন্ত্রী। বিধান সভায় প্রথম বিরোধী দলনেতার পদ অলংকৃত করেন জ্যোতি বসু। তিনি শুধু সর্বাধিক মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রীর পদে থাকার রেকর্ড তৈরি করেননি, তিনি সবচেয়ে বেশি সময় বিরোধী দল নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিরোধী দল নেতা। এরপর ১৯৭১ সালে একবছরের জন্য আবার বিরোধী দল নেতার পদে আসীন হন বসু। তখন নিয়ম ছিল বিধানসভার মোট আসনের ছয় ভাগের একভাগ আসন পেতে হবে। পরে সেটা পাল্টে করা হয় মোট আসনের দশ শতাংশ আসন। বসুর পরে এই বিধানসভায় আরও দশ জন ওই গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে দায়িত্ব সামলালেও বিরোধী নেতা হিসেবে বসুর ভূমিকা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হিসাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বসুর পরে ওই চেয়ারে বসেছেন, খগেন্দ্র নাথ দাশগুপ্ত-১৯৬৭,  সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়-১৯৬৯,১৯৯১-৯৩, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়-১৯৭২-৭৭, আব্দুস সাত্তার-১৯৮২-৯০, জয়নাল আবেদিন-১৯৯৪-৯৬, অতীশ চন্দ্র সিনহা-১৯৯৬-২০০১, পঙ্কজ বন্দোপাধ্যায়-২০০১-৬,পার্থ চট্টোপাধ্যায়-২০০৬-১১,সূর্যকান্ত মিশ্র-২০১১-১৬, আব্দুল মান্নান-২০১৬-২১।


২০১৬ সালে বাম-কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়াই করেছিল, জোট শরিক কংগ্রেস বেশি আসন পাওয়ার সুবাদে বিরোধী দলনেতার চেয়ার চলে যায় কংগ্রেসের দখলে। প্রায় ১৫ বছর পর চেয়ার ফিরে পায় কংগ্রেস। মান্নানের আগে ওই চেয়ারে কংগ্রেসের হয়ে দায়িত্ব সামলেছেন কান্দির রাজা অতীশ চন্দ্র সিনহা। আবার কংগ্রেসের হাত থেকে ছিটকে যাবে এই চেয়ার? বাম-কংগ্রেস নেতারা দাবি করছেন, সবাইকে চমকে দিয়ে ক্ষমতায় ফিরবেন তারা। তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে বিরোধী দলনেতার চেয়ার যাবে দ্বিতীয় শক্তিশালী দলের হাতে। কিন্তু বর্তমানে যাবতীয় রাজনৈতিক সমীক্ষা এবং  রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনী যুদ্ধ শেষে ওই গুরুত্বপূর্ণ চেয়ার যাবে হয় বিজেপি, নয় তৃণমূলের কব্জায়। শুধু ক্ষমতার চেয়ার নয়, বিরোধী দলনেতার চেয়ার যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় রাজনীতিতে সেটা বারে বারে  প্রমাণ করেছেন জ্যোতি বসু, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় কিংবা অটল বিহারী বাজপেয়ীর মতো ব্যক্তিত্বরা।