নয়াদিল্লি: বিতর্কের মধ্যেই লোকসভায় পেশ হল ওয়াকফ সংশোধনী বিল। সেই নিয়ে সরগরম দেশের সংসদ। অধিবেশন শুরুর আগে সংসদের বাইরে বিক্ষোভ দেখান কংগ্রেস সাংসদরা। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বিল পেশ করা সময় তীব্র বিরোধিতা জানান বিরোধীরা। তবে বিজেপি-র তরফে বিল পাশ নিয়ে আত্মবিশ্বাস ধরা পড়ছে। কারণ কেন্দ্রে তাদের জোট নির্ভর সরকারের শরিক দলগুলি, TDP, JDU, শিবসেনা (একনাথ শিন্ডে), লোক জনশক্তি পার্টি রামবিলাস শাখা ইতিমধ্যেই বিলটিতে সমর্থন জানিয়েছে। দলের সব সাংসদকে দুই কক্ষে হাজির থাকতে বলে হুইপ জারিও করেছে বিজেপি ও জোট সরকারের শরিক দলগুলি। বিলের বিরোধিতায় এককাট্টা কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি এবং তৃণমূলও। ওয়াকফ বিল নিয়ে আলোচনার জন্য আট ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করা হয়েছে। (Waqf Amendment Bill)
ওয়াকফ সংশোধনী বিলকে আগেই ‘অসংবিধানিক এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী’ বলে অভিযোগ করেছে একাধিক বিরোধী দল। সেই নিে এদিন সংসদে বিরোধীদের নিশানা করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু। তিনি দাবি জানান, ওয়াকফ বোর্ডে স্বচ্ছতা আনতেই এই বিল। স্বাধীনতার পর ওয়াকফ বিল অসাংবিধানিক মনে না হলে, এখন কেন মনে হচ্ছে, সেই নিয়ে বিরোধীদের বেঁধেন রিজিজু। কিন্তু বিরোধীরা একজোট হয়ে এর প্রতিবাদ জানান। (Waqf Bill in Lok Sabha)
রিজিজু এদিন লোকসভায় জানান, ২০১৩ সালে এমন কিছু পদক্ষেপ করা হয়, তার জন্যই ওয়াকফ বিলটি সংশোধন করতে হচ্ছে তাঁদের। তিনি বলেন, "২০১৩ সালে নিয়ম চালু হয় যে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, যে কেউ ওয়াকফ সম্পত্তি তৈরি করতে পারে। ইউপিএ সরকার এই কাণ্ড ঘটায়। শিয়া বোর্ডে শিয়া থাকবে, সুন্নি বোর্ডে শুধু সুন্নি থাকবে বলে নিয়ম আনা হয়। ১০৮ ধারায় লেখা হয়, ওয়াকফ বোর্ডের বিধি দেশের অন্য আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে। দেশে এমন বিধি থাকতে পারে কি?"
রিজিজু আরও বলেন, "ওয়াকফ নিয়ে ১৯৭০ থেকে দিল্লিতে মামলা চলছিল। সিজিও কমপ্লেক্স, সংসদভবন ছিল। দিল্লি ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে এই সব ওয়াকফের সম্পত্তি বলে। সেই সময় UPA সরকার সব জমি ডিনোটিফাই করে ওয়াকফ বোর্ডকে দিয়ে দেয়। আমরা আজ বিল সংশোধন না করলে যে সংসদে আমরা বসে আছি, তাও ওয়াকফ বোর্ড নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করা হচ্ছিল। ১২৩টি সম্পত্তি, UPA সরকার টিকে থাকলে, নরেন্দ্র মোদিজির সরকার না এলে, না জানি কত বিল্ডিং চলে যেত।"
রিজিজু এই দাবি করতেই তীব্র প্রতিবাদ জানান বিরোধীরা। সংসদে দাঁড়িয়ে রিজিজু মিথ্যা দাবি করছেন বলে দাবি করেন তাঁরা। এতে রিজিজু জানান, তিনি মনগড়া গল্প বলছেন না। রেকর্ড আছে তাঁর কাছে। এতে বিরোধীরা রেকর্ড দেখতে চান। কিন্তু তাঁদের থামিয়ে দেন স্পিকার ওম বিড়লা। প্রত্যেকে বলার সুযোগ পাবেন বলে জানান তিনি। স্পিকারের আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন বিরোধীরা, তাতে বিড়লা বলেন, স্পিকারের সিদ্ধান্তই সংসদে চূড়ান্ত।
এর পরও লাগাতার প্রতিবাদ জানাতে থাকেন বিরোধীরা। সেই আবহেই রিজিজু বলেন, "সরকার কোনও ধর্মীয় সংগঠন বা তাদের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করছে না। কোনও মসজিদের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করছি না আমরা। ওয়াকফ বোর্ডের সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয় এটি। যে কোনও ভারতীয় ওয়াকফ সম্পত্তি তৈরি করতে পারে বলে ১৯৯৫ সালে লেখা ছিল না। আপনারা এই পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। আমরা বলেছি, অন্তত পক্ষে ৫ বছর ইসলামের অনুগামী হলে তবেি তা করা যাবে। ওয়াকফ বোর্ডে শিয়া, সুন্নি, বোহরা, মুসলিমদের অনগ্রসর শ্রেণিও থাকবে, মহিলা সদস্যও থাকবেন এবং অমুসলিম বিশেষজ্ঞকেও রাখার কথা বলা হয়েছে। চারজন অমুসলিম সদস্য রাখতেই হবে, তবে দুই মহিলা সদস্য থাকা বাধ্যতামূলক।"
দেশে রেল এবং প্রতিরক্ষার পর ওয়াকফের কাছেই সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি ছিল বলে এতদিন রেকর্ড ছিল। কিন্তু এদিন লোকসভায় রিজিজু জানান, রেলের সম্পত্তি, সেনার সম্পত্তি আসলে দেশের সম্পত্তি। কিন্তু ওয়াকফের সম্পত্তি বেসরকারি সম্পত্তি। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে ভারতেই। তার পরও দেশে মুসলিমরা এত দরিদ্র কেন, প্রশ্ন তোলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি দরিদ্র মুসলিমদের জন্যই এই পদক্ষেপ করছেন বলে দাবি করেন রিজিজু। যাঁরা বিলটির বিরোধিতা করছেন, আগামী প্রজন্ম তাঁদের মনে রাখবে, ভোটব্যাঙ্কের নামে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করে রাখা যাবে না বলে দাবি করেন। সাচার কমিটির রিপোর্ট তুলে ধরে রিজিজু দাবি করেন, ২০০৬ সালে ৪.৯ লক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল, যা থেকে আয় হয় ১৬৩ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে রদবদল ঘটানোর পর আয় বেড়ে হয় ১৬৬ কোটি টাকা, মাত্র ৩ কোটি। ১০ বছরে পৃথিবীর বৃহত্তম সম্পত্তির আয় যতি ৩ কোটি টাকা বাড়ে, তা মেনে নেওয়া যায় না। ঠিক ভাবে ম্যানেজ করা গেলে ১২০০০ কোটি টাকা আয় হতো, এতে মুসলিমদের উপকার হতো। রিজিজুর দাবি, বর্তমানে ওয়াকফ সম্পত্তি বেড়ে ৮.৭২ লক্ষ হয়েছে। ঠিক ভাবে ম্যানেজ করা গেলে দেশের ভাগ্য পাল্টে যাবে।
ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল
এই ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে গোড়া থেকেই বিতর্ক। ওয়াকফ (সংশোধনী) বিলে বলা হয়েছে, ১) কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ ঘোষণার অধিকার আর ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকবে না, বরং জেলাশাসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন। ২) ওয়াকফ বোর্ডে দুই মহিলা সদস্যের পাশাপাশি, দুই অমুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি রাখাও বাধ্যতামূলক। ৩) মুসলিম এবং অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর ধরে যাঁরা ইসলাম ধর্ম পালন করে আসছেন, একমাত্র তাঁরাই ওয়াকফ বোর্ডকে সম্পত্তি দান করতে পারবেন। ৪) হিন্দু মন্দিরের মতো ওয়াকফ বোর্ডও ধর্মনিরপেক্ষ বিধিবদ্ধ সংস্থা বলে গন্য হবে। এর আগে লোকসভায় সংশোধনী বিলটি পেশ করা হলে, বিরোধীরা আপত্তি জানান। শেষ পর্যন্ত একমত হতে যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে বিলটি পাঠানো হয়। কিন্তু একতরফা ভাবে, অন্যায় ভাবে কমিটির চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত নিতে চাইছেন বলে অভিযোগ তোলা হয় বিরোধীদের তরফে। শেষ পর্যন্ত আজ বিলটি সংসদে পেশ করা হল।
কেন্দ্রের প্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল নিয়ে বিরোধীদের দাবি, আসলে ওয়াকফ বোর্ডের গুরুত্ব খর্ব করাই এই বিলের লক্ষ্য। ওয়াকফ বোর্ডে মহিলাদের উপস্থিতির প্রস্তাবকে যদিও স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, অন্য ধর্মীয় সংস্থাগুলির বোর্ডে ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধিদের স্থান নেই যেখানে, সেখানে ওয়াকফ বোর্ডের জন্য ভিন্ ধর্মের প্রতিনিধির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে কেন? অতি সম্প্রতি যদি কোনও ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে কেন সম্পত্তি দান করার জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে কেন, এই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। অন্য ধর্মের বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে দাবি তাঁদের। ওয়াকফ বোর্ডকে 'ধর্মনিরপেক্ষ' হতে হবে বলে প্রস্তাব দেওয়া হলেও, পুরীর মন্দিরে কেন অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেই প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীরা। মুসলিমদের হাতে থাকা জমি কেড়ে নিতেই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডও।