Boota Singh and Zainab: পাকিস্তান থেকে ফেরাতে পারেননি স্ত্রীকে, বাস্তবের তারা সিংহের পরিণত হয়েছিল মর্মান্তিক, ‘গদর’ ছবির নেপথ্য কাহিনি আজও মোচড় দেয় বুকে
দেশভাগের ক্ষত নিয়ে তৈরি হয়েছে ডজন ডজন সিনেমা। বাস্তব ঘটনাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কখনও, কখনও আবার বাস্তবের সঙ্গে মেশানো হয়েছে কল্পনাকে। জনপ্রিয় হিন্দি ছবি ‘গদর: এক প্রেম কথা’ও তেমনই এক ছবি। শীঘ্রই মুক্তি পাচ্ছে ছবি সিক্যুয়েল ‘গদর-২’। তার আগে প্রথম ছবিটির নেপথ্যকাহিনী জেনে নেওয়া প্রয়োজন। নেহাত শিল্পীর কল্পনা নয়, ‘গদর’ ছবির গল্প আসলে নেওয়া বাস্তব থেকেই।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In App‘গদর’ ছবিতে বিস্তর টানাপোড়েনের পর ‘তারা সিংহ’ এবং ‘সাকিনা’র প্রেমকাহিনী সফল হতে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। বরং প্রেমের জন্য শহিদ হতে হয়েছিল বাস্তবের ‘তারা সিংহ’কে। জনমানসে তাই ‘শহিদ-ই-মহব্বত’ হিসেবে রয়ে গিয়েছেন বাস্তবের ‘তারা সিংহ’।
‘গদর’ ছবিতে ‘তারা সিংহে’র চরিত্রে দেখা গিয়েছে সানি দেওলকে। সেই চরিত্রটি বোনা হয়েছে তৎকালীন ইংরেজ সেনার প্রাক্তন কর্মী বুটা সিংহের জীবন অবলম্বনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বর্মায় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বুটা সিংহ। আদতে পঞ্জাবের লুধিয়ানার (ইস্ট) বাসিন্দা ছিলেন।
দেশভাগের সময় সাম্প্রদায়িক হিংসায় তেতে ওঠে পঞ্জাব। তদানীন্তন ইস্ট পঞ্জাবে মুসলিম পরিবাররে সদস্যদের নৃশংস ভাবে খুন, মেয়েদের অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসতে থাকে। পাকিস্তান যাওয়ার পথে তেমনই এক মুসলিম পরিবারের মেয়ে জাইনাবকে অপহরণ করে দুষ্কৃতীরা।
এর পর দুর্বিসহ হয়ে ওঠে জাইনাবের জীবন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, পণ্যের মতো এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষের হাতে বিক্রি হতে থাকেন তিনি। বুটা সিংহও জাইনাবকে অর্থের বিনিময়েই লাভ করেন। কিন্তু একসঙ্গে থাকতে থাকতে পরস্পরের প্রতি টান জন্মায় তাঁদের। বিষয়টি চাউর হতে সময় লাগেনি। জাইনাবকে খুন করতে বুটা সিংহের বাড়িতে একদিন চড়াও হয় উন্মত্ত ভিড়। এর পর জাইনাবের প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে বিয়ে করেন বুটা সিংহ। তাঁদের দুই কন্যা জন্মায়, তনবীর এবং দিলবীর।
যন্ত্রণা ভুলে নতুন সংসারে জড়িয়ে পড়েন জাইনাব। ঘরকন্নায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু প্রায় একদশক পর আবারও তাঁর জীবনে সঙ্কট নেমে আসে। সেই সময় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার আওতায় দুই দেশের অপহৃত মহিলাদের নিজের নিজের দেশে ফেরানো হবে বলে ঠিক হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের মার্চ মাসের পর যদি কোনও মহিলা বাধ্য হয়ে ভিন্ ধর্মের ব্যক্তিকে বিয়ে করে থাকেন, সেক্ষেত্রেও বিষয়টি অপহরণ হিসেবে ধার্য হবে বলে ঠিক হয়।
এর পর এমন মহিলাদের খোঁজ শুরু হয় দুই দেশেই। সেই সময় বুটা সিংহের ভাইপো জাইনাবের কথা জানিয়ে দেন প্রশাসনকে। জাইনাব এবং তাঁর সন্তান পাকিস্তানে ফেরত গেলে সব সম্পত্তি তাঁদের হাতে চলে আসবে ভেবেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বুটা সিংহের ভাইপো। দেশভাগের সময় ইস্ট পঞ্জাবের বড় অংশে মুসলিম নিধন, মুসলিম মেয়েদের উপর অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছিল যেহেতু, তাই দুই দেশের সরকারই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে শুরু করে।
বিষয়টি জানাজানি হতেই জাইনাবকে পাকিস্তান ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ছোট মেয়ে দিলবীরের হাত ধরে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়ান জাইনাব। গোটা গ্রাম তাঁকে বিদায় জানাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গাড়িতে ওঠার আগে, বুটা সিংহ এবং বড় মেয়ে তনবীরকে জাইনাব জানান, তিনি ঠিক ফিরে আসবেন। এর পর পাকিস্তানের লাহৌরের বাইরে নরপুর গ্রামে ঠাঁই হয় জাইনাব। সেখানে পরিবারের সঙ্গে আবার মিলিত হন তিনি।
কিন্তু এর পর ঘটনাক্রম অন্য দিকে মোড় নেয়। জাইনাবের মা-বাবার মৃত্যু হয়। তাতে জাইনাব এবং তাঁর বোন ইস্ট পঞ্জাবে বিশাল সম্পত্তির মালকিন হয়ে ওঠেন। তাঁদের সম্পত্তির ঠিক পাশেই জাইনাবের এক কাকার সম্পত্তি ছিল। সব যাতে পরিবারেই থেকে যায়, তার জন্য ওই কাকা নিজের ছেলের সঙ্গে জাইনাবের বিয়ে দিতে তৎপর হন। লাগাতার চাপ সৃষ্টি করা হয় জাইনাবের উপর। জাইনাবের বিয়েতে মত ছিল না। বিয়েতে মত ছিল না তাঁর ওই কাকার ছেলেরও।
এর পর পাকিস্তান থেকে জাইনাবের এক পড়শি বুটা সিংহকে চিঠি লেখেন। জাইনাবকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার আর্জি জানান। কিন্তু পাকিস্তান যাওয়া সহজ ছিল না। হাজারো বার সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হন বুটা সিংহ। শেষে জমিজমা বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেন। ধর্ম পরিবর্তন করে জামিল আহমেদ নাম নেন বুটা সিংহ। এর পর স্বল্পমেয়াদি ভিসায় পাকিস্তানে প্রবেশ করেন বুটা সিংহ। কিন্তু তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। জাইনাবের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাঁর কাকার ছেলের।
বুটা সিংহ স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ের কথা জানতে পারেননি। তাই পাকিস্তান পৌঁছে জাইনাবকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন। তাতে পাকিস্তানে পৌঁছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে দেশের পুলিশের কাছে হাজিরা দেওয়ার কথা, তা ভুলে যান। ফলে বুটা সিংহকে গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হয়। সেই সময় স্ত্রী জাইনাবকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করার দাবি জানান বুটা সিংহ। আদালতের সমন পেয়ে হাজিরও হন জাইনাব। কিন্তু বুটা সিংহের সঙ্গে ভারতে ফিরতে রাজি হননি তিনি। বরং ছোট মেয়ে দিলবীরকেও বুটা সিংহের হাতে তুলে দেন। দেশে ফিরে যেতে বলেন। পরিবারের চাপেই তিনি এমন আচরণ করেন বলে শোনা যায়।
কিন্তু স্ত্রীকে ছেড়ে দেশে ফেরার কথা ভাবতেই পারেননি বুটা সিংহ। ওই রাতেই চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। লাহৌরে তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত হয়। বুটা সিংহের নিথর দেহ দেখতে সেই সময় ভিড় উপচে পড়েছিল। কান্নায় ভেঙে পড়েন শত শত মানুষ। বুটা সিংহের পকেট থেকে একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার হয়, যাতে জাইনাবের গ্রামেই সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু তাতেও আপত্তি তোলে জাইনাবের পরিবার। শেষ পর্যন্ত লাহৌরের মিয়ানি সাহিবে সমাধিস্থ করা হয় বুটা সিংহকে।
জাইনাব এবং বুটা সিংহের দুই মেয়ের দৌলতেই আজও এই কাহিনি বেঁচে রয়েছে। পাকিস্তানেও বুটা সিংহকে ‘শহিদ-ই-মহব্বত’ হিসেবে স্মরণ করা হয়। তাঁর সমাধি কার্যতই দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মুসলিম মেয়েকে অর্থের বিনিময়ে কেনা বুটা সিংহকে নিয়ে এই মাতামাতি পছন্দ হয়নি অনেকেরই। তাই বুটা সিংহের সমাধিও ভাঙচুর করা হয়। কিন্তু আজও তাঁর স্মৃতি রয়ে গিয়েছে। জাইনাব এবং বুটা সিংহের প্রেম কাহিনি নিয়ে পরবর্তী কালে একাধিক ছবি তৈরি হয়েছে যেমন, ‘গদর’, ‘বীর-জারা’, ‘পার্টিশন’, ‘শহিদ-ই-মহব্বত: বুটা সিংহ’।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -