মহাশ্বেতা দেবী: এক মহাজীবন
একসঙ্গে এক নাগাড়ে সাহিত্যচর্চা এবং সামাজিক কাজের এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তবে বৃহস্পতিবার থেমে গেল সেই কলম। চলে গেলেন মহাশ্বেতা। থেকে গেল তাঁর লড়াই। প্রতিবাদের নজির হয়ে।
Download ABP Live App and Watch All Latest Videos
View In Appদেশভাগের পর পাবনা থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে। সেখান থেকেই ইংরেজিতে স্নাতক। তারপর স্নাতকোত্তরের পাঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পঠনপাঠন পর্ব শেষেই পরিচয় গণনাট্য আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা বিজন ভট্টাচার্যর সঙ্গে পরিচয়। ১৯৪৭ সালে বিয়ে হলেও ১৯৫৯ সালে দু’জনের বিচ্ছেদ। পরে অসিত গুপ্তর সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে হলেও, ১৯৭৬ সালে তাও ভেঙে যায়। বিজন মহাশ্বেতার একমাত্র সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্যও প্রখ্যাত সাহিত্যিক। বার্ধক্যে পৌঁছে সেই ছেলের মৃত্যুশোকও সহ্য করতে হয়েছে মহাশ্বেতাকে। ২০১৪ সালে জুলাইয়ে নবারুণের মৃত্যু হয়।
মানুষের অধিকার রক্ষার এই লড়াই-ই মহাশ্বেতাকে তাঁর রাজনৈতিক সচেনতনতা হারাতে দেয়নি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। এই সময় থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও কাছাকাছি আসেন মহাশ্বেতা। তবে মমতার সঙ্গে মহাশ্বেতার সম্পর্ক ছিল রৌদ্র-ছায়ার মতো। কখনও কাছে কখনও দূরে। কখনও তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে রাজধর্ম পালনের বার্তা দিয়েছেন। কখনও সরব হয়েছেন সরাসরি। তবে তিনি বরাবরই ছিলেন মানুষের লড়াইয়ের পক্ষে। নিজের গায়ে কোনও রাজনৈতিক দলের রং কখনও লাগতে দেননি। তাই তো মহাশ্বেতার শেষ যাত্রাতেও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দেখা গিয়েছে বহু রাজনীতিককে। শাসক থেকে বিরোধী। সকলেই শোকাহত।
ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে একাধিকবার বিদেশেও গিয়েছেন মহাশ্বেতা দেবী। ১৯৮৫ সালে ভারত– ফরাসি সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমের সদস্য হিসেবে যান প্যারিসে। ১৯৮৬ ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ভারতীয় লেখক দলের সদস্য হিসেবে যান পশ্চিম জার্মানি ও লন্ডন ভ্রমণ। ১৯৮৮ সালে ‘মার্কসিস্ট স্টাডি সার্কল’-এর আমন্ত্রণে যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯২ সালে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রকের আহ্বানে বাঙালি লেখিকা হিসেবে ফ্রান্সেও যান মহাশ্বেতা।
এক সাক্ষাৎকারে মহাশ্বেতা বলেছিলেন, লেখাই একমাত্র কাজ যা আমি করতে পারতাম। আমি পেশায় লেখক এটাই আমার পরিচয়। লেখালেখির সমস্ত সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবেই লেখাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলাম। বেস্টসেলার হওয়ার জন্য নয়।
সাহিত্য কীর্তির জন্য বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন মহাশ্বেতা। অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের জন্য ১৯৭৯-এ পান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। পরে সম্মানিত হন পদ্মশ্রী, পদ্মবিভূষণ, জ্ঞানপীঠ, রামন ম্যাগসাইসাই, বঙ্গবিভূষণ সহ একাধিক পুরস্কারে। তবে মহাশ্বেতার কাছে এসব পুরস্কারের থেকেও অনেক বড় ছিল সাধারণ মানুষের ভালবাসা। তাই পুরস্কারের থেকেও তিনি যত্ন করে রাখতেন আদিবাসী, উপজাতিদের দেওয়া মানপত্রগুলি।
মহাশ্বেতার কলম হয়েই তো নিম্নবর্গীয় প্রান্তিকদের যন্ত্রণা পৌঁছেছিল শহরবাসীর কাছে। মহাশ্বেতাই তাঁদের লড়াই শিখিয়েছেন। তাঁদের হয়ে লড়াই করেছেন। তাই মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যিক পরিচয়ের পাশাপাশি সমান উজ্জ্বল তাঁর সামাজিক কর্মী পরিচয়টিও।
১৯৬৪ সালে বিজয়গড় কলেজ শিক্ষকতার মধ্যে দিয়েই চাকরিজীবন শুরু করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশিই চালিয়ে যান সাংবাদিকতা, লেখালেখি। ১৯৭৫ সালে ‘হাজার চুরাশির মা’, ১৯৭৭ সালে ‘অরণ্যের অধিকার’ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলেছিল। এরপর একে একে অগ্নিগর্ভ, তিতুমীর, রুদালি। তাঁর লেখার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে রুদালি, ‘হাজার চওরাশি কি মা’, ‘গঙ্গোর’- সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র।
কলম ছিল তাঁর প্রতিবাদের ভাষা। কলম ছিল তাঁর লড়াইয়ের অস্ত্র। কলম ছিল তাঁর জীবনের সঙ্গী। বৃহস্পতিবার থেমে গেল সেই কলম। চলে গেলেন মহাশ্বেতা দেবী। বাংলা সাহিত্য হারাল তার ‘হাজার চুরাশির মা’-এর স্রষ্টাকে। আর বাংলার প্রান্তিক অঞ্চলের উপজাতিভুক্ত অসংখ্য মানুষ হারাল তাদের মারাং দাই-কে। আদর করে মহাশ্বেতাকে এই নামেই ডাকতেন তাঁরা। মারাং দাই। অর্থাৎ মা।
১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম বাংলাদেশের পাবনায়। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, সবটাই সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহে। বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক। মা ধরিত্রী দেবীও লেখালেখি করতেন। সেই সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমাজসেবার কাজে। পরিচালক ঋত্বিক ঘটক মহাশ্বেতা দেবীর কাকা। বড়মামা নাম করা অর্থনীতিবিদ, ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শচীন চৌধুরী। মায়ের মামাতো ভাই কবি অমিয় চক্রবর্তী।
- - - - - - - - - Advertisement - - - - - - - - -