কলকাতা: সালটা ২০১৫। ৮ অক্টোবর। ইডেনে (Eden Gardens) ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা (Ind vs SA) টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। বাদ সাধল বৃষ্টি। কিন্তু দুপুর দেড়টার বৃষ্টিতে মাঠ এমন ভিজল যে, রাত সাড়ে নটাতেও মাঠকে খেলা শুরুর উপযুক্ত করে তোলা গেল না। প্রবল বিতর্কের মধ্যে মাঠ ছাড়লেন প্রবীর মুখোপাধ্যায় (Prabir Mukherjee)। ইডেনের প্রবীণ কিউরেটর আর কোনওদিন মাঠমুখো হননি। কয়েক মাস পর তিনি প্রয়াতও হন।
সুজন মুখোপাধ্যায় (Sujan Mukherjee) যখন ইডেনের দায়িত্ব নেন, তাঁর সামনে তখন অগ্নিপরীক্ষা। ইডেনের বিতর্কিত আউটফিল্ডের চরিত্র বদলের চ্যালেঞ্জ। পিচকে স্পোর্টিং করে তোলার কঠিন কাজ। সর্বোপরি মাঠের জল নিষ্কাশনী ব্যবস্থার ঢেলে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা। যার অভাবে সামান্য়তম বৃষ্টিতেও মাঠ কর্দমাক্ত হয়ে যায়। ম্যাচ শুরু করা কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। আর ম্যাচ বাতিল মানেই খেলা দেখতে আসা দর্শকদের প্রবল ক্ষোভ। বাড়তি তিক্ততা বলতে, সিএবি কর্তাদের সম্মানহানি।
ঘাবড়াননি সুজন। কল্যাণীতে বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ছক ভেঙে বাউন্সি পিচ করে ততদিনে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছেন। কিউরেটর হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে ইডেন সংস্কারের কাজে হাত দিয়েই করলেন বহুদিন ধরে আটকে থাকা অথচ ভীষণ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কী ছিল সেই কাজ? 'ইডেনে এঁটেল মাটির আউটফিল্ড ছিল। সামান্য বৃষ্টিতেও যা কাদা হয়ে যেত। শুকোত না। মাঠের মাটি বদলানো জরুরি ছিল। আমি সচিব থাকাকালীনই অস্ট্রেলিয়া থেকে কোরিং মেশিন কেনা হয়েছিল। তাতে মাঠে বালি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। তাতে মাটির চরিত্রগত পরিবর্তনও হয়। বালির ভাগ বাড়ায় জল নিষ্কাশন সুগম হয়। কিউরেটর হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই কোরিং করে মাঠে পর্যাপ্ত বালি মিশিয়ে দিই,' এবিপি লাইভকে বলছিলেন সুজন।
বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা ক্রিকেট কর্তা সুজন বললেন, 'ইডেনের পিচ মন্থর গতির ছিল। বল পড়ে ধীর গতিতে ব্যাটে যেত, স্পিনাররা সাহায্য পেত। রান কম উঠত। পেসাররা সেভাবে সাহায্য পেত না। আমি ঠিক করেছিলাম উইকেট এমন করব যেখানে পেসাররাও বাউন্স ও গতি পাবে। বদলে ফেলা হয়েছিল পিচের মাটি। চন্দননগর থেকে মাটি এনে ফেলা হয়েছিল বাইশ গজে। তাতেই সুফল পাই। বারমুডা সিলেক্ট ওয়ান ঘাস দিয়ে মাঠ ও বাইশ গজ মুড়ে ফেলা হয়। এই ঘাস জল ধরে রাখে না। বাড়ে দ্রুত। মাটির বাঁধনটা ধরে রাখে আরও ভালভাবে। তাতেই ভোলবদল।'
সেই সঙ্গে মাঠের জল নিষ্কাশনী ব্যবস্থারও আমূল সংস্কার করা হয়। আর বিদেশ থেকে আনা হয় গ্রাউন্ডকভার। অত্যাধুনিক। বৃষ্টি হলে ইডেন ঢাকতে আগে যে কভার ব্যবহার করা হতো, তাতে এমন আর্দ্রতা তৈরি হতো যে, তাতেই পিচে বা মাঠে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে ভাব তৈরি হয়ে যেত। নতুন আনা কভারে সেই ঝামেলা নেই। বৃষ্টি শুরু হলে সামান্য সময়ে ঢেকে ফেলা যায় মাঠ। আর বৃষ্টি থামলে দ্রুত মাঠকে খেলার উপযুক্ত বানিয়ে ফেলা যায়। দর্শকরাও মনোরঞ্জন থেকে বঞ্চিত হন না।
সেই সঙ্গে যে ইডেনে একসময় ওয়ান ডে-তে গড়ে আড়াইশো রান উঠত, টি-টোয়েন্টিতে যে মাঠে কলকাতা নাইট রাইডার্সের জয়ের ফর্মুলাই ছিল টস জিতে শুরুতে ব্যাটিং করে বোর্ডে ১৪০ তোলো আর তারপর প্রতিপক্ষকে সুনীল নারাইনের স্পিন-জালে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলো, সেখানেই উলটপুরাণ। পেসাররা পিচে আগুন ছোটাতে শুরু করলেন। ব্যাটে দেখা গেল চার-ছক্কার ফুলঝুরি। ওয়ান ডে-তে তিনশো জলভাত।টি-টোয়েন্টি ম্যাচে এক ইনিংসে দুশোও উঠছে হরদম। দেশে তো বটেই বিশ্বেও ইডেনের পিচের বদলে যাওয়া চরিত্র নিয়ে জোর চর্চা। যা এখনও চলছে।
সুজন বলছিলেন, 'প্রায়ই টিভিতে শুনছি অন্যান্য দেশের খেলার সময়ও ধারাভাষ্যকারেরা ইডেন পিচের কথা উল্লেখ করছেন। এটাই তো বড় প্রাপ্তি। মাঠকর্মীরা প্রত্যেকে দারুণ কাজ করেছেন। সকলে মিলেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। এই কৃতিত্ব সকলের প্রাপ্য।' ইডেনের পিচ দেশের সেরা উইকেটের পুরস্কারও পেয়েছে।
ইডেন-সাফল্য এবার সুজনকে আরও বড় দায়িত্ব দিয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বোর্ডের পিচ কমিটিতে জায়গা করে দিয়েছেন সুজনকে। বোর্ডের প্রধান কিউরেটর আশিস ভৌমিক যে খবর দেওয়ার পর থেকে আপ্লুত সুজন। বলছেন, 'এটা বড় সম্মান। সৌরভ আমার ওপর আস্থা রেখেছে। ইডেনের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য মাঠের পিচ তৈরির কাজ তদারকির দায়িত্বও নিতে হবে। শীঘ্রই আলোচনা করে কী করতে হবে বুঝে নেব।'
আরও পড়ুন: প্রথম ভারতীয় হিসাবে টেস্টে হ্যাটট্রিক, অবসরের দিনও উজ্জ্বল ভাজ্জির কীর্তি
আর ইডেন? সুজন বলছেন, 'বোর্ডের পিচ কমিটিতে থাকলেও নিজের রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার কাজ করায় কোনও সমস্যা হবে না। ইডেনের পিচ তৈরির কাজও আগের মতো আমিই দেখাশোনা করব।'