Bengal Pro T20: বাবার শ্রাদ্ধের আগেই দলের স্বার্থে মাঠে নেমে পড়লেন, ইডেনে রূপকথা বনগাঁর ক্রিকেটারের
Raju Halder: উদ্যমে ঘাটতি নেই। ভোর পাঁচটার বনগাঁ লোকাল ধরে শিয়ালদা। তারপর ময়দান। ম্য়াচ খেলে সন্ধ্যার ট্রেন ধরে বাড়ি। দিনের পর দিন একই রুটিন। রাজু স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলা দলে সুযোগ পাবেনই।

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: বাবা মারা যাওয়ার খবর শুনে শোকস্তব্ধ সচিন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মাঝেই ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু দেশের স্বার্থে পিতৃবিয়োগের ধাক্কা সরিয়ে রেখে ইংল্যান্ডে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিনিয়ার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরির পর সচিনের শূন্যপানে চেয়ে বাবাকে খোঁজার ছবি ভারতীয় ক্রিকেটে অমর হয়ে রয়েছে।
বাবার মৃত্যুর পর শোক সামলে দিল্লির হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠে নেমে পড়েছিলেন বিরাট কোহলি (Virat Kohli)। কর্নাটকের বিরুদ্ধে দলকে ফলো অনের লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছিলেন। সেই কাহিনি এখনও ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে।
ক্রিকেট শ্রেষ্ঠত্বের ধারে-ভারে সচিন-কোহলিদের থেকে যোজন যোজন দূরে বনগাঁর রাজু হালদার। তবু, কোনও এক অদৃশ্য সুতো যেন বঙ্গ ক্রিকেটারকে বেঁধে ফেলল দুই কিংবদন্তির সঙ্গে!
বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা সহ্য করেও বাংলার বাঁহাতি স্পিনার রাজু নেমে পড়েছিলেন মাঠে। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আগেই। বেঙ্গল প্রো টি-২০ লিগে সার্ভোটেক শিলিগুড়ি স্ট্রাইকার্সের জার্সিতে ইডেনে প্রথম ম্যাচে তিন উইকেট নেন। অ্যাডামাস হাওড়া ওয়ারিয়র্সের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে হেরে যায় শিলিগুড়ি। তবু প্রশংসিত হয় রাজুর বোলিং। সেই সঙ্গে নজর কেড়ে নেয় তাঁর মুণ্ডিতমস্তক চেহারাও। বাবার ঘাটকাজ সেরে মাঠে নেমেছিলেন যে! বৃহস্পতিবারের সেই ম্যাচ খেলে বাড়ি ফেরার পরের দিন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সারেন বনগাঁর বাড়িতে। তারপর ফের যোগ দিয়েছেন দলের সঙ্গে। শনিবার সন্ধ্যায় ইডেনে রশ্মি মেদিনীপুর উইজার্ডসের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলতে নামবেন।
এবিপি আনন্দকে রাজু বলছিলেন, 'বাবা বিশ্বনাথ হালদার অনেক কষ্ট করে আমাদের বড় করেছে। রিকশা চালাত। পরে আমি রেলে চাকরি পাওয়ার পর বাবাকে রিকশা চালাতে বারণ করি। সেই থেকে একটা ছোট ব্যবসা করত।' কীভাবে আচমকা মৃত্যু? 'বনগাঁ হাটে গিয়েছিল বাবা। সেখানে পড়ে গিয়ে তলপেটে চোট পায়। পাকস্থলির পাশে ছিদ্র হয়ে পিত্তরস বেরতে শুরু করে। তার থেকেই সমস্ত অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। বনগাঁয় চিকিৎসা হয় প্রথমে। অবস্থার অবনতি হওয়ায় কলকাতায় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ২৮ মে মৃত্যু হয় বাবার।'
ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট ভালবাসেন রাজু। বনগাঁয় কোনও ক্রিকেট খেলা থাকলেই মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দেখতেন। পাড়ার অ্যাকাডেমিতে কোনও দল খেলতে এলে মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে বল ধরে ছুড়ে দিতেন। সেই প্রথম ডিউস বল হাতে ধরা। রাজু বলছিলেন, 'বনগাঁর সেই অ্যাকাডেমির কোচ রোজ আমাকে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একদিন ডেকে বলেন, কী রে, খেলবি? বাবাকে গিয়ে বলেছিলাম। তবে বাবার মাইনে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না।'
যদিও পরে নিখরচায় অনুশীলনের ব্যবস্থা হয়। শুরু হয় রাজুর ক্রিকেট সফর। কিন্তু ক্রিকেট সরঞ্জাম কেনার পয়সা কোথায়? তাই সকালে পড়াশোনা আর ক্রিকেট। রাতে কাগজের প্লেট তৈরির কারখানায় কাজ করতেন রাজু। কখনও সেলসম্যানের কাজ। সেখান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই ক্রিকেট কিট কেনা, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা।
কলকাতা ময়দানে কীভাবে? রাজু বলছেন, 'আমার কোচ কলকাতায় দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব স্যর গুরুদাস ইনস্টিটিউটে সই করান। শুরুর দিকে মাঠে জল বয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কাজ থাকত না। কাস্টমস মাঠ থেকে জলের বোতল নিয়ে ক্রিকেটারদের জল খাওয়াতাম। তারপর একদিন এক ম্যাচে ক্লাবের দল নামানোর সময় দশজন হচ্ছিল। এগারোতম ক্রিকেটার আসেনি। সেই জায়গায় আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়। বিপক্ষের একটা লম্বা পার্টনারশিপ হচ্ছিল। সেই জুটি ভাঙি আমি। তিনটি উইকেট নিই অভিষেক ম্যাচেই। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।'
তিন বছর দ্বিতীয় ডিভিশন খেলার পর প্রথম ডিভিশনে সুযোগ। প্রথমে শ্যামবাজার, তারপর ওয়াইএমসিএ, বড়িশা স্পোর্টিং, ইস্টার্ন রেল হয়ে এই মরশুমে খেলেছেন নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউটে।
রেলে চাকরি করেন রাজু। ওয়ার্কশপে ট্রেনের বগিতে মেরামতির কাজ করেন। বাড়িতে রয়েছেন মা, স্ত্রী, সন্তান ও এক ভাই। রাজু বলছেন, 'বাবাকে বহুবার বলেছি মাঠে আমার খেলা দেখতে আসার জন্য। কখনও আসেনি। বলত, তোর খেলা যেদিন টিভিতে দেখাবে, সেদিন দেখব। গত মরশুমে হাওড়া ওয়ারিয়র্সের হয়ে বেঙ্গল প্রো টি-২০ খেলার সময় টিভিতে খেলা দেখে। এবার মাঠে আসবে বলেছিল। সে ইচ্ছা অপূর্ণই রইল।' বাবাকে হারানোর শোক ভুলে মাঠে নামলেন, মনের জোর পেলেন কীভাবে? রাজুর কথায়, 'বাবা শিখিয়েছেন, কখনও যেন নিজের কাজে সন্তুষ্ট না হয়ে যাই। বলত, কাজই ধর্ম। বাবার কথা মেনেই মাঠে নেমেছি।'
বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ দলে খেলেছেন। তবে সিনিয়র দলে খেলার সুযোগ পাননি। সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-২০-র দলে ছিলেন। একাদশে সুযোগ মেলেনি। ইস্টার্ন রেলের হয়ে ৬৫ উইকেট নিয়ে গত মরশুমে স্থানীয় ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হয়েছিলেন। এই মরশুমে ৫৮ উইকেট নিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক উইকেটের মালিক। তবু, বাংলা দলে কোনও এক অজানা কারণে ব্রাত্য। কী কারণে, জানেন না রাজুও।
তবে তাঁর উদ্যমে ঘাটতি নেই। ভোর পাঁচটার বনগাঁ লোকাল ধরে শিয়ালদা। তারপর ময়দান। ম্য়াচ খেলে সন্ধ্যার ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা। দিনের পর দিন একই রুটিন। রাজু স্বপ্ন দেখেন, একদিন বাংলা দলে সুযোগ পাবেনই।
করুণ নায়ারের একটা পোস্ট ভাইরাল হয়েছিল। ভারতীয় দলে দ্বিতীয় সুযোগ না পেয়ে হতাশ করুণ প্রার্থনা করেছিলেন, প্রিয় ক্রিকেট, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও। করুণের প্রার্থনা পূরণ করেছেন ক্রিকেট ঈশ্বর। ইংল্যান্ড সফরের ভারতীয় দলে রয়েছেন তিনি।
বনগাঁর রাজু হালদারও ক্রিকেটের কাছে প্রাপ্য সুযোগের আর্জি জানাচ্ছেন। ক্রিকেট ঈশ্বর কি সাড়া দেবেন?




















