Richa Ghosh Exclusive: ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরও সাহসী, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে বাবার আক্ষেপ মেটালেন শিলিগুড়ির রিচা
India Women's Cricket Team: ভারতীয় মহিলাদের বিশ্বজয় আর ফাইনালে রিচার ঝলমলে পারফরম্যান্সের পর আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না মানবেন্দ্র।

সন্দীপ সরকার, কলকাতা: শিলিগুড়ি কলেজের পাশে হাতিমোড়ে রিচা ঘোষের (Richa Ghosh) বাড়িতে ঢুকলেই অনেকে চমকে উঠতেন। সারা বাড়ির অনেক জানালার কাচ ভাঙা! বাড়িতে কেউ বা কারা হামলা চালিয়েছে নাকি!
ভুল ভাঙবে বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বললেই। পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলে দেবেন, বাড়ির জানালার কেন এই হাল। এই বাড়ি থেকেই যে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল ডাকাবুকো এক তরুণীর। ছোট থেকেই ব্যাট হাতে দাপিয়ে বেড়াতেন বাড়িময়। তাঁর একের পর এক জোরাল শট আছড়ে পড়ত জানালায়। ভেঙে পড়ত কাচ। আশায় বুক বাঁধতেন এক মাঝবয়সী। তাঁর আক্ষেপ বোধ হয় ছোট মেয়েই মেটাবে।
রিচার বাবা মানবেন্দ্রও যে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন। ক্লাব ক্রিকেটও খেলেছেন। কিন্তু স্বপ্ন স্পর্শ করতে পারেননি। সংসার চালাতে এক সময় রেস্তোরাঁও খুলেছিলেন শিলিগুড়ি কলেজের সামনে। সেটাও বন্ধ করে দেন মেয়েকে আরও সময় দেওয়ার জন্য। বাইশ গজ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। বাংলার ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা সিএবি-র স্বীকৃত আম্পায়ার মানবেন্দ্র। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি রিচার।
ভারতীয় মহিলাদের বিশ্বজয় আর ফাইনালে রিচার ঝলমলে পারফরম্যান্সের পর তাই আবেগ ধরে রাখতে পারছেন না মানবেন্দ্র। মহিলাদের ওয়ান ডে বিশ্বকাপের ফাইনাল দেখতে সপরিবার গিয়েছিলেন নবি মুম্বইয়ে। ডি ওয়াই পাটিল স্টেডিয়ামে মায়াবী রাত উপহার দিয়েছে ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৫২ রানে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন টিম ইন্ডিয়া। সোমবার সকালেও যেন ঘোরের মধ্যে ছিলেন রিচার বাবা।
মুম্বই থেকে মোবাইল ফোনে মানবেন্দ্র বললেন, 'কাল সারারাত ঘুমোইনি। আমার স্বপ্নটা পূরণ হয়ে গিয়েছে। প্রাপ্তির জন্য এর চেয়ে বড় মঞ্চ হয় না। বাকি স্বপ্ন ওর। এই গোটা ক্রিকেটীয় সফরেই ওর পাশে থাকব। যে দিনটির স্বপ্ন আমি দেখতাম, সেটা পেয়ে গিয়েছি। তারই সেলিব্রেশন হবে। জানি না কতদিন চলবে।'
অনেকের ধারণা, বাঙালিরা চাপের মুখে কেঁপে যায়, বাঙালিরা পারে না, সেই বাংলার মেয়েই দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে কি সব ভ্রান্ত ধারণা নতুন করে ভেঙে দিলেন? মানবেন্দ্র বলছেন, 'আমি কোনও দিন এভাবে দেখিনি, এভাবে ভাবিওনি। ও আমার মেয়ে। তবে ও কী পারবে, কী করবে, সেই ব্যাখ্যা কখনও খুঁজতে চাইনি।' যোগ করলেন, 'ও অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে, এবার ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জিতল। মাঝে ডব্লিউপিএল জিতেছে। আর কী চাহিদা থাকতে পারে! আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু আশা করব, এতদিন যা করেছে, সেটাই করে যাবে। মাঠে ও মাঠের বাইরে ওরাই আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়াই করেছি, অল্পের জন্য কয়েকটা ম্যাচে হেরেছি, ভাগ্যও কিছু ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেয়নি, তবে স্বপ্নটা ওরাই দেখিয়েছে। কাল রাতে সেটাই ওরা বাস্তবায়িত করেছে।'
রিচার ভয়ডরহীন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদেরও প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। ম্যাচের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সাবলীল ব্যাটিং থেকে পিছিয়ে আসেননি। আগ্রাসন দেখিয়েছেন। মানবেন্দ্র বলছেন, 'ও বরাবরই ডাকাবুকো মেয়ে। ছোট থেকে আমি ছিলাম ওর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার সঙ্গে ক্রিকেট খেলত। আমি যত দূরে বল মারতাম, ও চ্যালেঞ্জ নিত তার চেয়েও দূরে মারবে। সেভাবেই ও তৈরি হয়েছে। মানসিকভাবে আরও দৃঢ়চেতা হয়েছে।'
কী দেখে মনে হয়েছিল রিচা ক্রিকেটে সফল হতে পারে? মানবেন্দ্র বলছেন, 'আমি স্থানীয় ক্রিকেট খেলতাম। নিজে বেশিদূর খেলতে পারিনি, তাই মেয়েকে ক্রিকেটার হিসাবে গড়তে চেয়েছিলাম। শিলিগুড়ির বাঘাযতীন অ্যাথলেটিক ক্লাবের সদস্য আমি। সেখানেই আমার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্লাবে টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। আমি ওকে খেলাধুলোর মধ্যে রাখার জন্য টিটিতে ভর্তি করি। কিন্তু রিচা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। ও একটু শারীরিক পরিশ্রমের খেলা খেলতে চাইত। তারপরই ক্রিকেট শুরু। আমার ব্যাট-বল নিয়েই খেলত। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, ক্রিকেট খেলবি? ও রাজি হয়। চার বছর বয়সে ক্লাবে ভর্তি হয়।'
অ্যাকাডেমির সবচেয়ে খুদে শিক্ষার্থী ছিলেন রিচা। ছেলেদের সঙ্গে মিলে প্র্যাক্টিস করতেন। পাল্লা দিতেন। সাহসী মানসিকতার বীজবপনও সেখানেই। মানবেন্দ্র বলছেন, 'ও ক্রিকেটে খুব মনোযোগ দিত। স্ট্রোক খেলার একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত দক্ষতা ওর মধ্যে ছিল। ব্যাট ফ্লো দুর্দান্ত। তা দেখেই সকলের মনে হয়েছিল, এই মেয়ে অনেক দূর যাবে।'
রিচার বয়স তখন আট বছর। ইডেন গার্ডেন্সে (Eden Gardens) সিএবি আয়োজিত বাংলার অনূর্ধ্ব ১৯ ট্রায়ালে যোগ দেন। অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মানবেন্দ্র বলছিলেন, 'তার দু'বছর পরে কল্যাণীর শিবিরে যোগ দেয়। বাংলা দলে সুযোগ পায়। বিভিন্ন জেলা দলের সঙ্গে খেলায় ও ওপেনিং করতে নেমে অপরাজিত থাকত। পারফরম্যান্সের জন্যই ও বাংলার অনূর্ধ্ব ১৯ দলে ডাক পায়। তারপর অনূর্ধ্ব ২৩ দলে সুযোগ, বাংলা সিনিয়র দলে ডাক। তরতর করে এগিয়েছে।'
🚨 NEWS 🚨
— BCCI (@BCCI) November 3, 2025
BCCI announces Cash Prize of INR 51 Crore for India's victorious ICC Women’s Cricket World Cup 2025 contingent.
Details 🔽 #TeamIndia | #WomenInBlue | #CWC25 | #Champions https://t.co/EUXzv8PpXD
শুরু থেকেই উইকেটকিপিং করতেন রিচা। তবে অনেকেই যেটা জানেন না, বাংলার হয়ে বোলিংও করেছেন শিলিগুড়ির ক্রিকেটার। মানবেন্দ্র বললেন, 'বাংলা ওকে নতুন বলে বোলার হিসাবেই ব্যবহার করেছিল। সেখানেও ভাল করেছিল।'
ফাইনালে নামার আগে রিচার মানসিক প্রস্তুতি কেমন ছিল? মানবেন্দ্র বলছেন, 'ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। দৃঢ়সংকল্প ছিল। আমি কিছু বলতে গেলেই মনে করিয়ে দিত, নেতিবাচক কথা বলবে না। ও জানে কী করতে হবে। বাবা হিসাবে ভয় হতো। আজ বুঝতে পারছি, সত্যিই ও মানসিকভাবে কতটা মজবুত।'
ক্রিকেটের বাইরে রিচা ভালবাসেন লং ড্রাইভে যেতে। বাড়িতে থাকলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে। ঈশ্বরভক্ত। কিটব্যাগে, ঘরে রয়েছে আরাধ্য দেবতার ছবি। গোটা দেশকে মায়াবী রাত উপহার দেওয়া বঙ্গকন্যার জন্য গর্ব করছে বাংলার প্রত্যেকে।



















