দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও একটা বছর। ২০২২ সালটিও খেলাধূলোর দুনিয়ায় ঘটনার ঘনঘটা ঘটেছে। বছরের শুরুতে নোভাক জকোভিচের ভ্যাকসিন বিতর্ক। ফেডেরার, সেরেনা, সানিয়ার অবসর। কমনওয়েলথ গেমসে রেকর্ড ৬১টি পদক জয় ভারতের। ক্রিকেট- ফুটবলের বাইরে অন্যান্য খেলায় সারাবছর কী হয়েছে, তার একটা ছোট্ট খতিয়ান তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।
জকোভিচের ভিসা বাতিল
করোনার টিকা না নিয়েই খেলতে এসেছিলেন। যাবতীয় বিতর্ক কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলার জন্য দ্বিতীয় বার ভিসার আবেদন করেছিলেন। তবে দেশের স্বার্থ ও সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নোভাক জকোভিচের সেই আবেদন বাতিল করে দিয়েছিল ফেডারেল আদালত। আদালতে জোকারের আইনজীবী একাধিক বিষয় নিয়ে তর্ক করলেও, তিন বিচারপতি সেই আবেদন খারিজ করে দেন। না খেলেই অস্ট্রেলিয়া ছাড়তে হয় সার্বিয়ান তারকাকে।
সানিয়ার অবসর
২০২২ মরসুমটাই শেষ। সম্প্রতি এই ঘোষণা করেন ভারতের টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। ১৯ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে মহিলাদের ডাবলসের প্রথম রাউন্ডে হারের পর অবসরের ঘোষণা করেন সানিয়া। জানিয়ে দেন ২০২২ মরসুমের পর তিনি ব়্যাকেট তুলে রাখবেন।
অ্যাসলে বার্টি চ্যাম্পিয়ন ও অবসর
কেরিয়ারের প্রথম অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন সেদেশেরই অ্যাশলে বার্টি। মহিলাদের টেনিসে বিশ্বের এক নম্বর বার্টি এর আগে উইম্বলডন ও ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতলেও নিজের ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এখনও অধরাই ছিল। কিন্তু এবার সেই আক্ষেপও পূরণ করে ফেললেন বার্টি। ফাইনালে তিনি হারিয়ে দিলেন আমেরিকান ড্যানিয়েল কলিন্সকে। ৬-৩,৭-৬ সেটে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে কেরিয়ারের তৃতীয় গ্র্যান্ডস্লামও জিতলেন তিনি। একইসঙ্গে ৪৪ বছর পর ঘরের কোর্টে কোনো অজি টেনিস তারকার হাতে উঠল অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের খেতাব। ১৯৭৮ সালের পর ২০২২ এ।
যদিও সবাইকে অবাক করে দিয়ে মার্চ মাসে মাত্র ২৫ বছর বয়সে টেনিসকে বিদায় জানান বার্টি।
নাদালের দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেন
কেরিয়ারের ২১ তম গ্র্যান্ডস্লাম জিতলেন রাফায়েল নাদাল। পুরুষদের টেনিস এই মুহূর্তে তিনিই সর্বাধিক গ্র্য়ান্ডস্লামের মালিক। একইসঙ্গে কেরিয়ারের দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনও জিতলেন স্প্যানিশ টেনিস তারকা। ফাইনালে রাশিয়ার ড্যানিল মেদভেদেভকে হারিয়ে দিলেন রাফা। টপকে গেলেন নোভাক জকোভিচ ও রজার ফেডেরারে গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের সংখ্যা। প্রথম ২ সেট হেরে পরের তিন সেটে পরপর জিতে ম্যাচ পকেটে পুরে নেন স্প্যানিশ টেনিসের সুপারস্টার। খেলার ফল নাদালের পক্ষে ২-৬, ৬-৭ (৫-৭), ৬-৪, ৬-৪, ৭-৫। ২০০৯ সালের পর ফের ২০২২ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি।
নিখাত জারিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন
পঞ্চম ভারতীয় মহিলা বক্সার হিসাবে থাইল্যান্ডের জিতপং জুতামাসকে পরাস্ত করে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলেন নিখাত জারিন। বিচারকরা ফাইনালে ৩০-২৭, ২৯-২৮, ২৯-২৮, ৩০-২৭, ২৯-২৮ স্কোরলাইনে ভারতীয় বক্সারের পক্ষে রায় দেন।
প্রয়াত নরেশ কুমার
ভারতের প্রাক্তন ডেভিস কাপ অধিনায়ক তথা লিয়েন্ডার পেজের মেন্টর হিসাবে খ্যাত নরেশ কুমার ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোক গমন করেন। ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যু হল ভারতীয় টেনিস প্রাক্তনীর। অ্যামাচার হিসাবে উইম্বলডনে ১০১টি ম্যাচ খেলার রেকর্ড রয়েছে তাঁর দখলে। ২০০০ সালে প্রথম টেনিস কোচ হিসাবে দ্রোণাচার্য লাইমটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার পেয়েছিলেন নরেশ কুমার। সেই তারকাই পৃথিবীকে বিদায় জানালেন।
ফেডেরারের অবসর
২৪ বছরের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের অবসান। ২০০৩ সালে কেরিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ডস্লাম জিতেছিলেন ফেডেরার। এরপর থেকে ৬টি অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, একটি ফরাসি ওপেন, ৮টি উইম্বলডন ও ৫টি ইউএস ওপেন জিতেছিলেন এই টেনিস কিংবদন্তি।
মনিকার নজির
এশিয়ান কাপ টেবিল টেনিসে ইতিহাস গড়লেন ভারতীয় প্যাডলার মণিকা বাত্রা । সেমিফাইনালে তিনি হেরে গিয়েছিলেন। তবে ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচ জিতে ভারতীয় টেবল টেনিসে নতুন ইতিহাস লিখে ফেললেন মণিকা। প্রথম ভারতীয় মহিলা টিটি প্লেয়ার হিসাবে এশিয়ান কাপে পদক জিতলেন তিনি। শনিবার ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে বিশ্বের ৬ নম্বর জাপানের হিনা হায়াতাকে ৪-২ হারিয়ে নজির গড়ে ফেললেন ভারতের তারকা প্যাডলার। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি এশিয়ান কাপে পদক জিতলেন।
উনিশেই বাজিমাত ইউ এস ওপেন
ইউ এস ওপেন চ্যাম্পিয়ন স্পেনের কার্লোজ আলকারাজ। মাত্র ১৯ বছর বয়সেই গ্র্য়ান্ডস্লাম জয় কার্লোজের। হারিয়ে দিলেন ক্য়াসপার রুডকে।
করোনা প্রতিশেধক না নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ওপেন থেকেও নাম তুলে নিয়েছিলেন নোভাক জকোভিচ।
বরিস বেকারের ফের জেল
ব্যাঙ্ক প্রতারণা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বড়সড় শাস্তির মুখে পড়তে হল প্রাক্তন টেনিস তারকা বরিস বেকারকে (Boris Becker)। ২০১৭ সালেই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে দিয়েছিলেন টেনিস কিংবদন্তি। পরে জানা যায়, তিনবারের উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন আসলে বিরাট সম্পত্তির কথা গোপন করে গিয়েছিলেন। সেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আড়াই বছরের জেল হল বরিস বেকারের। জার্মান এই টেনিস প্লেয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রাক্তন স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে সাড়ে তিন লক্ষ পাউন্ড ট্রান্সফার করেও তা গোপন করেন। পাশাপাশি অনেক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন বরিস। উইম্বলডন ট্রফি, জার্মানিতে একাধিক স্থাবর সম্পত্তি এবং লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাঁর নামে।
ভবানীর কমনওয়েলথে সোনা
ফেন্সিংয়ে কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতেছিলেন ভবানী দেবী। ফাইনালে ভবানী হারান অস্ট্রেলিয়ার ফেন্সার ভেরোনিকা ভাসিলেভাকে। খেলার ফল ভবানীর পক্ষে ১৫-১০।
সিন্ধুর সোনা জয়
কমনওয়েলথে গেমসে সোনা জয় ব্যাডমিন্টনে। দুরন্ত ফর্ম বজায় রেখে কানাডার মিচেল লি-কে একপ্রকার উড়িয়ে দিলেন সিন্ধু। খেলার ফল সিন্ধুর পক্ষে ২১-১৫, ২১-১৩।
সোনা শরথ-শ্রীজা জুটির
কমনওয়েলথে টেবিল টেনিসের মিক্সড ডাবলসে সোনা জয় শরথ কমল ও শ্রীজা আকুলা জুটির। ডাবলসে রুপো জিতেছিলেন শরথ। মিক্সড ডাবলসে প্রতিপক্ষ মালয়েশিয়ার জাভেন চুং ও কারেন লিনকে ১১-৪, ৯-১১, ১১-৫, ১১-৬ ব্যবধানে হারান শরথ-শ্রীজা জুটি।
হাইজাম্পে পদক তেজস্বীনের
ভারতের কোনও অ্যাথলিট কোনওদিন যা পারেননি, তাই করে দেখালেন তেজস্বীন শঙ্কর। কমনওয়েলথে গেমসে হাই জাম্পে পদক জিতলেন। এর আগে কমনওয়েলথ গেমসের মঞ্চে ভারতের কোনও অ্যাথলিট হাই জাম্পে পদক জিততে পারেননি। সেদিক থেকে দেখলে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন শঙ্কর। জাতীয় রেকর্ডের অধিকারী শঙ্কর হাই জাম্পের ফাইনালে ২.২২ মিটার লাফালেন। জিতে নিলেন ব্রোঞ্জ।
অচিন্ত্য শিউলির সোনা
বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে দেশকে তৃতীয় সোনা এনে দিলেন এক বাঙালি। ভারোত্তোলনে পুরুষদের ৭৩ কেজি বিভাগে সোনা জিতলেন হাওড়ার পাঁচলার দেউলপুরের অচিন্ত্য শিউলি। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে মোট ৩১৩ কেজি ওজন তুলে কমনওয়েলথের মঞ্চে বাজিমাত করেন অচিন্ত্য। স্ন্যাচ ও মোট ওজন তোলার নিরিখে নতুন গেমস রেকর্ড গড়লেন বাঙালি তরুণ।
সোনা মীরাবাঈ চানুর
মহিলাদের ৪৯ কেজি বিভাগে সোনা জয় মীরাবাঈ চানুর। স্ন্যাচে ৮৮ কেজি ওজন তুললেন। যা তাঁর ব্যক্তিগত সেরা পারফরম্যান্স। জাতীয় রেকর্ড। সেই সঙ্গে কমনওয়েলথ গেমসেও নতুন রেকর্ড।
স্ন্যাচের পর ক্লিন অ্যান্ড জার্কেও চলল চানু-রাজ। প্রথম প্রচেষ্টায় ১০৯ কেজি ওজন তোলেন তিনি। সব মিলিয়ে তাঁর তোলা ওজন দাঁড়ায় ১৯৭ কেজি। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আরও ৪ কেজি বেশি, অর্থাৎ ১১৩ কেজি ওজন তোলেন চানু। স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে চানুর তোলা মোট ওজন দাঁড়ায় ২০১ কেজি। যা কমনওয়েলথ গেমসে নতুন রেকর্ড। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে তৃতীয় প্রচেষ্টায় ১১৫ কেজি ওজন তোলার চেষ্টা করেছিলেন চানু। যদিও সেই প্রচেষ্টায় তিনি সফল হননি।
বিন্দিয়ারানির রুপো জয়
কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে ৫৫ কেজি বিভাগে রুপো জেতেন বিন্দিয়ারানি। স্ন্যাচিংয়ে প্রথম চেষ্টায় ৮১ কিলো তোলেন বিন্দিয়ারানি। দ্বিতীয় বারের চেষ্টায় ৮৪ কেজি তোলেন। তৃতীয় চেষ্টায় ৮৬ কেজি তোলেন। এরপর ক্লিন অ্যান্ড জার্ক বিভাগে ১১৬ কেজি ভারোত্তোলন তুলে পদক নিশ্চিত করেন বিন্দিয়ারানি। মোট ২০২ কেজি তোলেন তিনি।
লভপ্রীতের ব্রোঞ্জ জয়
পুরুষদের ১০৯ কেজি ভারোত্তোলনে ব্রোঞ্জ জেতেন লভপ্রীত সিংহ । ভারতীয় অ্যাথলিট প্রথম প্রচেষ্টায় ১৫৭ কেজি ওজন তোলেন তিনি। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় আরও ৪ কেজি ওজন বাড়িয়ে ১৬১ কেজি সাফল্যের সঙ্গে তুলে নেন লভপ্রীত । তৃতীয় প্রচেষ্টায় ১৬৩ কেজি ওজন তোলেন তিনি । তবে স্ন্যাচে লড়াইটা হয় হাড্ডাহাড্ডি। স্ন্যাচ বিভাগের পর তিন নম্বরে ছিলেন লভপ্রীত । ক্লিন অ্যান্ড জার্কেও দুরন্ত পারফর্ম করেন লভপ্রীত। প্রথম প্রচেষ্টায় ১৮৫ কেজি ওজন তোলেন তিনি। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ৪ কেজি ওজন বাড়িয়ে ১৮৯ কেজি তোলেন লভপ্রীত। তখনও পর্যন্ত তিনিই তালিকার এক নম্বরে ছিলেন। তৃতীয় প্রচেষ্টায় লভপ্রীত আরও তিন কেজি ওজন বাড়িয়ে ১৯২ কেজি তোলেন। যা নতুন ভারতীয় রেকর্ড। সব মিলিয়ে ৩৫৫ কেজি ওজন তোলেন লভপ্রীত।
স্কোয়াশে পদক জয়
৩৫ বছর বয়েসে ইতিহাস গড়লেন সৌরভ ঘোষাল। কমনওয়েলথ গেমস ২০২২- এ স্কোয়াশে ব্রোঞ্জ জেতেন তিনি। ইতিমধ্য়েই উচ্ছ্বাসে ভেসেছে সারা দেশ। বুধবার স্কোয়াশে দেশের অন্যতম সেরা স্কোয়াশ খেলোয়াড় হিসেবে সৌরভ ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে নামেন। জেমস উইলসট্রপ-কে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে স্কোয়াশের পুরুষদের সিঙ্গলসে ব্রোঞ্জ জয় করেন বঙ্গ সন্তান।
নজির নীরজের
বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ইতিহাস গড়লেন নীরজ চোপড়া। প্রথম ভারতীয় পুরুষ অ্যাথলিট হিসেবে রুপো জিতলেন পানিপথের তরুণ। চতুর্থ প্রয়াসে এদিনের সেরা থ্রোটি করেন নীজর। ৮৮.১৩ মিটার দূরত্বে থ্রো করে রুপো নিশ্চিত করেন নীরজ। তবে সোনা জয় হল না এবার। হয়ত নিজের পারফরম্যান্সে একটু হতাশই হবেন তিনি। কারণ নব্বই মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে মরিয়া ছিলেন টোকিও অলিম্পিক্সের সোনাজয়ী। যা সম্ভব হল না। ২০০৩ সালে অঞ্জু ববি জর্জের পর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আবার পদক জয় ভারতের।