কলকাতা: প্রথম দর্শন দু’দশক আগে। ২০০০ সালে। ইডেনে রঞ্জি ট্রফির সেই ম্যাচে তাঁরা ছিলেন একে অপরের প্রতিপক্ষ। তারপর কখন যেন তাঁরা প্রতিপক্ষ থেকে বন্ধু হয়ে উঠেছেন! পূর্বাঞ্চলের হয়ে একসঙ্গে ম্য়াচ খেলা থেকে শুরু করে ভারত এ দলের হয়ে বিদেশ সফর, বেলেঘাটায় বাইক নিয়ে ঘোরা, টিমহোটেলে রুম শেয়ার। বাংলার যে কজন ক্রিকেটারের সঙ্গে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, শিবশঙ্কর পাল তাঁদের অন্যতম। ধোনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পরে এবিপি আনন্দের কাছে বন্ধুর নানা মজাদার কাহিনি শোনালেন বাংলার প্রাক্তন পেসার।


প্রথম বিদেশ সফরের সঙ্গী

ধোনির মতো মানুষ হয় না। ২০০৪ সালে ভারত এ দলের হয়ে কিনিয়া সফরে গিয়েছিলাম। সেটা ছিল আমাদের দুজনেরই প্রথম বিদেশ সফর। সন্দীপ পাটিল আমাদের কোচ। দলে নতুন আমরা। সাইরাজ বাহুতুলে, রোহন গাওস্কর, হেমাঙ্গ বাদানি, আবিষ্কার সালভি, মুনাফ পটেলরা ছিল আমাদের দলে। আমি আর ধোনি রুম পার্টনার ছিলাম। তার পরেও একাধিক জায়গায় আমি আর ধোনি রুম শেয়ার করেছি। তবে সেবারের অভিজ্ঞতাটা ছিল স্পেশ্যাল। হয়তো দুজনেরই প্রথম বিদেশ সফর বলে।

২০০৪ সালে কিনিয়া সফরের ফাঁকে।

তাঁবুর পাশে হায়নার ডাক

সেবার কিনিয়া সফর চলাকালীন আমরা সকলে মিলে মাসাইমারা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিলাম। একটা রিসর্টে আমরা ৩ রাত্রি আর ৪ দিন ছিলাম। ভোর তিনটের সময় তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়তাম। রাত্রে ক্যাম্প ফায়ার জ্বালিয়ে ডিনার করতাম। চারপাশের জঙ্গল থেকে হায়না ও অন্যান্যা বুনো জন্তুদের ডাক। সে এক গা ছমছমে অভিজ্ঞতা। তবে একদিনের অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলব না। জিপে চড়ে জঙ্গল সাফারিতে বেরিয়েছিলাম। আমাদের পই পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল, সামনে জন্তু জানোয়ার এলে যেন কোনওরকম আওয়াজ না করি। কিছু পরেই আমাদের গাড়ির সামনে দুটো বুনো হাতি এল। আমরা সকলে দম বন্ধ করে বসে আছি। ধোনি আচমকাই মুখ থেকে একটা আওয়াজ করল। ব্যাস। আর দেখে কে! একটা প্রকাণ্ড হাতি ক্ষেপে গিয়ে শুঁড় উঁচিয়ে তেড়ে এল। আমরা দিশাহারা। বুক ধুকপুক করছে সকলের। আমাদের চালক অবশ্য করিৎকর্মা। এইরকম মুহূর্তে কী করতে হয় জানতেন। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তিনি দ্রুত গাড়ি পিছিয়ে নেন। আমরা কোনওমতে প্রাণে বাঁচি। পরে কোচ সন্দীপ পাটিল পরিস্থিতি সামাল দেন।

হেলিকপ্টার শটের ওষুধ

ধোনির সঙ্গে একসঙ্গে প্রচুর ম্যাচ খেলেছি। ওর সঙ্গে আলাপ সম্ভবত ইডেনে বাংলা বনাম বিহার রঞ্জি ট্রফির ম্যাচে, ২০০০ সালে। পরে দলীপ ও দেওধর ট্রফিতে পূর্বাঞ্চলের হয়ে প্রচুর ম্যাচ খেলেছি। ওর সঙ্গে এত ম্যাচ খেলেছি যে ওর শক্তি-দুর্বলতা জানতাম। সেই মতো বল করতাম। বাংলার বিরুদ্ধে ওর পারফরম্যান্স দুর্দান্ত ছিল না হয়তো সে কারণেই। ও আমার বলে কখনও হেলিকপ্টার শট খেলতে পারেনি। ওকে শরীর লক্ষ্য করে শর্ট লেংথে বল করতাম।

নেহরাকে এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে ছয়

মোহালিতে দলীপ ট্রফির ফাইনালে সেবার মুখোমুখি পূর্বাঞ্চল বনাম উত্তরাঞ্চল। উত্তরাঞ্চলের শক্তিশালী দল। যুবরাজ সিংহ থেকে শুরু করে আশিস নেহরা, সকলে খেলছে। নেহরার প্রথম বলেই ধোনি একটা ছয় মেরেছিল এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে! ওরকম শট খেলা মনে হয় ওর পক্ষেই সম্ভব ছিল। সেই ম্যাচে ও ঝোড়ো ৮০ রান করেছিল। নেহরাকে খুব পিটিয়েছিল।

ভারত এ দলে কোচ সন্দীপ পাটিলের সঙ্গে।

মাহি-মন্ত্রে কাত বাঙ্গার

ধোনির ম্যাচ রিডিং দারুণ। কোন ব্যাটসম্যান কখন কী করবে, আগাম বুঝে যেত। দেওধর ট্রফির একটা ম্যাচ মনে পড়ছে। পূর্বাঞ্চল বনাম মধ্যাঞ্চলের খেলা। সঞ্জয় বাঙ্গার ব্যাট করছিল। মাহি বলল, অফস্টাম্পের বাইরে আউটসুইং করা। করলাম। বাঙ্গার আউট হয়ে গেল। এটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও এরকম ম্যাচ রিডিং দেখেছি। ধোনিকে দেখেছি, যুজবেন্দ্র চাহাল-কুলদীপ চাহালদের পরামর্শ দিয়ে উইকেট তুলতে সাহায্য করেছে। ভারতের একটা ম্যাচে মনে আছে, চাহাল রাউন্ড দ্য উইকেট বল করছিল। মাহি বলল ওভার দ্য উইকেট ডাল, স্টাম্প পে বল ডাল। স্টাম্প মাইক্রোফোনেও সেটা শোনা গিয়েছিল। চাহাল সেই পরামর্শ শুনল আর উইকেট তুলে নিল।

বেলেঘাটায় স্প্লেন্ডার চালিয়ে ঘোরা, লাঞ্চে পাঁঠার মাংস

মাঠের বাইরে ভীষণ মজা করতে ভালবাসে ধোনি। কলকাতায় খেলতে এলেই আমার বেলেঘাটার বাড়িতে চলে আসত। তখনও ও তারকা হয়ে ওঠেনি। আমার স্প্লেন্ডার বাইক চালিয়ে ঘুরত। পাড়ায় যে মাসির দোকানে চা খেতাম, সেখানে গিয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারত। আমার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করেছে। বাঙালি খাবার ও পছন্দ করে। ভাত, মাছ, পাঁঠার মাংস খেত। চকোলেট কেক খেতে খুব ভালবাসত।

তুঝে চাহিয়ে? দামি সানগ্লাস দিয়েই দিল

পরে ধোনি যখন ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন হয়, বিশ্বকাপ জেতে, কোনওদিনও এড়িয়ে যেতে দেখিনি। বন্ধুদের সঙ্গে মাহি সেই মাটির মানুষ। ইডেনে খেলতে এসেও দেখা করেছে। আমি অনেক সময় ওর কোনও ভক্তকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছি। হাসিমুখে কথা বলেছে। ব্যাট-গ্লাভস-জুতো বিলিয়ে দিয়েছে। ওর একটা সানগ্লাস একবার আমার পছন্দ হয়। ওকলে-র দামি সানগ্লাস। ওকে বললাম, তোর সানগ্লাসটা দারুণ তো। বলল, তুঝে চাহিয়ে? লে লে। বলে উপহার দিয়ে দিল। মাহি মানে এতই দিলদরিয়া। ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিয়েছে। এরপরেও আইপিএল খেলবে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ওকে খুব মিস করবে।