কলকাতা: করোনার ধাক্কায় অর্ধসমাপ্ত রাখতে হয়েছে আইপিএল। বেশিরভাগ ক্রিকেটার যে যাঁর বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। টুর্নামেন্টের বাকি অংশ কবে আর কোথায় হবে, তা নিয়ে রয়েছে জল্পনা। তবে এখনও অনেকের চোখে লেগে রয়েছে বল হাতে দীপক চাহারের মুন্সিয়ানা। চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে এবারের আইপিএলের শুরুর দিকে নজর কাড়তে পারেননি ডানহাতি পেসার। বল হাতে খরচ করেছেন প্রচুর রান। কিন্তু অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন তিনি। পঞ্জাব কিংস ও কলকাতা নাইট রাইডার্স, এই দুই ম্যাচেই নিয়েছেন চারটি করে উইকেট। কার্যত একার হাতে প্রতিপক্ষ ব্যাটিংকে ধ্বংস করে চেন্নাইয়ের জয়ের পথ সুগম করে দিয়েছিলেন। সিএসকে-র সেরা পেসার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।


কীভাবে সম্ভব হল এই প্রত্যাবর্তন? টুর্নামেন্ট স্থগিত হওয়ার পর আগ্রায় নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন ২৮ বছরের পেসার। সেখান থেকে শনিবার রাতে মোবাইল ফোনে এবিপি লাইভ-কে দীপক বললেন, "পরিশ্রম সব সময়ই করি। নিজের সেরাটা দিই। এত কঠোর পরিশ্রম করি যে এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করার সময়ই পাই না (হাসি)। এ বছর আলাদা কিছু করিনি। তবে ক্রিকেটে সব সময় সমান যায় না। সব দিনই ব্যাট বা বল হাতে একইরকম পারফরম্যান্স হয় না। এবার পরের দিকে ছন্দ পেয়ে গিয়েছিলাম। বল হাতে ধারাবাহিকতা দেখাতে পেরেছি। তাতেই সাফল্য।"


পঞ্জাব ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ১৩ রানে ৪ উইকেট। কেকেআরের বিরুদ্ধে ২৯ রানে চার শিকার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে তো বোলারদের বধ্যভূমি মনে কর হয়। সেখানে এই ঈর্ষণীয় সাফল্য়ের রসায়ন কী? দীপক বলছেন, "টি-টোয়েন্টিতে বোলারদের জন্য সহজ নিয়ম। ব্যাটসম্যান প্রত্যেক বলেই চার-ছক্কা মারতে চায়। তাকে শট খেলতে দিলে হবে না। আমার পরিকল্পনা সব সময় থাকে যত বেশি সম্ভব ডট বল করতে হবে। তাতে ব্যাটসম্যানের ওপর প্রবল চাপ তৈরি হয় আর আক্রমণ করতে গিয়ে উইকেট খুইয়ে বসে।" যোগ করছেন, "টেস্ট ম্যাচের ব্যাকরণটা আলাদা। সেখানে অসাধারণ কিছু বল উইকেট আনে। ব্যাটসম্যান সামলাতে না পেরে উইকেটের পিছনে স্লিপ কর্ডনে ক্যাচ দিয়ে বসে। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে চাপ তৈরি করাটাই আসল। ডট বল করতে থাকলে ব্যাটসম্যান ঝুঁকি নেবেই। আমি সব সময় এই নিয়ম মেনে চলি।"



নিজের সেরা অস্ত্র হিসাবে বেছে নিচ্ছেন সুইংকে। দীপক বলছেন, "বল দুদিকে সুইং করাতে পারি। আর ফর্ম্য়াট যাই হোক না কেন, বল সুইং করলে আমি আত্মবিশ্বাসী থাকি।" পাশাপাশি স্লোয়ার থেকে শুরু করে ইয়র্কার, সবরকম অস্ত্র এখন মজুত রয়েছে তাঁর বোলিং তূণে। দীপক বলছেন, "ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করার জন্য টি-টোয়েন্টিতে সবরকম বল করতে হয়। যাতে ব্যাটসম্যান আপনাকে পড়তে না পারে। আগাম বুঝতে না পারে।"


ভারতীয় দলের হয়েও মনে রাখার মতো কিছু স্পেল রয়েছে দীপকের। যার মধ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭ রান দিয়ে ৬ উইকেটের অবিশ্বাস্য বোলিং রয়েছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে যা সেরা। পঞ্জাব ম্য়াচে ১৩ রান দিয়ে চার উইকেট। শিকারের তালিকায় ক্রিস গেল থেকে শুরু করে ময়ঙ্ক অগ্রবাল। দীপক বলছেন, "এরকম পারফরম্যান্স নিজে থেকে হয় না। ঈশ্বর করান। পঞ্জাব কিংস ম্যাচে ১৮টি ডট বল করেছিলাম। এর আগে আমার একটা রেকর্ড আছে। ২০১৯ সালে আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে ২০টা ডট বল করেছিলাম। উইকেট কখনও পাব, কখনও পাব না। তবে ডট বল করতে পারলে খুব আনন্দ পাই। সব কিছু হাতে থাকে না। ব্যাটসম্যান শট খেলতে গেলে অনেক সময় আউট হয়। কখনও আবার ক্যাচ পড়ে যায়। আবার যে বলটায় ময়ঙ্ক অগ্রবালকে বোল্ড করেছিলাম, সেটা রোজ হয় না। সব কিছু বোলারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। সেই দিন আপনি কেমন বল করছেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে ডট বল করলে ব্যাটসম্যানের ওপর চাপ তৈরি হবেই।" তিনি যোগ করছেন, "এক একটা দিন থাকে নতুন বলে একের পর এক ডট করতে থাকলে শুরুতেই বিপক্ষ শিবিরে চাপ তৈরি হয় আর পরপর উইকেট হারিয়ে ম্যাচে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়ানো যায় না। এরকম ম্যাচ গোটা মরসুমে এক-আধটা হয়। তবে এবার অর্ধেক টুর্নামেন্টেই দুবার এরকম পারফরম্য়ান্স করেছি।" 


সিএসকে-তে অধিনায়ক হিসাবে পেয়েছেন কিংবদন্তি মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে। যে কারণে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন দীপক। "আমি যা, সবই মাহি ভাইয়ের জন্য। আমাকে গোটা একটা মরসুম খেলিয়েছিল সিএসকে-র হয়ে। তাতেই আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল। নতুন বলে বোলিং করায়। সব সময় আমার দক্ষতায় আস্থা দেখিয়েছে। রঞ্জি ট্রফি খেলে তারপর সিএসকে-র হয়ে এক মরসুম আইপিএল খেলেছিলাম। তাতেই ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। মাহি ভাইয়ের অবদান ভোলার নয়," বলছিলেন দীপক। যোগ করলেন, "মাহি ভাই অনেক পরামর্শ দিয়েছে। তবে বড় ম্যাচের আগে একটা কথা বলে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মার খাবে। হয়তো এক ওভারে ৫ ছক্কা খেলে। কিন্তু শেষ বলে একটা উইকেট তুলতে পারলে ম্যাচ জেতা যায়। মাহি ভাইয়ের এই সহজ সরল দর্শন আমায় ভীষণ সাহায্য করেছে। আমার বড় দাদার মতো। সবরকম কথা শেয়ার করি। মাহি ভাইয়ের ঘরেই তো বেশি সময় কাটাই। একসঙ্গে গেম খেলি।"



দলের জয়ে অবদান রাখতে পেরে খুশি ক্রিকেট পরিবারের সন্তান। বাইশ গজে যাঁর হাতেখড়ি নিজের বাবার কাছে। খুড়তুতো ভাই রাহুল চাহার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের অন্যতম সেরা স্পিন-অস্ত্র। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন রাহুলও। দীপক বলছেন, "মুম্বইয়ে পাঁচ ম্যাচের মধ্যে আমরা চারটিতে জিতেছি। আর দলকে ম্যাচ জেতাতে পারাটা আলাদারকম তৃপ্তি। আমাদের দলের প্রধান শক্তি ব্যাটিং ও স্পিন বোলিং। ওয়াংখেড়েতে আমরা কতটা ভাল খেলব, সেটা নিয়ে অনেকের সংশয় ছিল। তবে আমরা জিতে দেখিয়েছি।"


আপাতত সকলের নিরাপদে বাড়ি ফেরার প্রার্থনা করছেন তিনি। বলছেন, "দল থেকে বলা হয়েছে, ক্রিকেটারদের ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দলের অনেক বিদেশি ক্রিকেটার এখনও ফিরতে পারেনি। তাদের ফেরানোর ব্যবস্থা চলছে।"


অর্ধসমাপ্ত আইপিএলে সেরা উইকেট? দীপক বলছেন, "টি-টোয়েন্টিতে সব উইকেটই তৃপ্তিদায়ক। আমি সেরা ব্যাটসম্যানদের আউট করেছি। যারা একার হাতে ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে। তবে ময়ঙ্ক অগ্রবালকে যে বলটায় বোল্ড করেছিলাম, সেটা খেলা সম্ভব ছিল না। মিডল-লেগ স্টাম্পে পড়ে বলটা আউট সুইং করে অফস্টাম্প উড়িয়ে দিয়েছিল। টুর্নামেন্টে আমার করা সেরা বল ছিল ওটা।"