প্যারিস: কোথায় ভিনদেশি প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে অঙ্ক কষবেন, তা নয়, নিজের দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেই গত বছর দেড়েক কাটিয়ে ফেলেছিলেন বিনেশ ফোগত (Vinesh Phogat)!


প্রতিপক্ষ এক, জাতীয় কুস্তি সংস্থার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ সিংহ (Brij Bhusan Saran Singh)। যিনি আবার কেন্দ্রের শাসক দলের বাহুবলী সাংসদও। যাঁর বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্থা করার গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল। যাঁর অপসারণের জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছিল সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ পুনিয়াদের। সঙ্গে ছিলেন বিনেশও। ঝড়-জল-রোদ্দুর উপেক্ষা করে রাজধানীতে যন্তর মন্তরের সামনে ধর্না দিয়ে গিয়েছেন চোয়াল শক্ত করে।


প্রতিপক্ষ দুই, জাতীয় কুস্তি সংস্থার পরবর্তী প্রধান সঞ্জয় সিংহ। যিনি ব্রিজভূষণের ডানহাত হিসাবেই পরিচিত। বিনেশ-সাক্ষী-বজরঙ্গরা যখন ধর্নায় বসেছিলেন এবং প্রস্তুতির যথেষ্ট সুযোগ পাননি বলে যোগ্যতা অর্জনকারী পর্ব থেকে তাঁদের অব্যহতি দেওয়ার আবেদন করেছিলেন, তখন তার কড়া বিরোধিতা করেছিলেন সঞ্জয়। বজরঙ্গকে পরে ডোপ পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগে অলিম্পিক্সের দৌড় থেকেই ছেঁটে ফেলা হয়। সাক্ষী খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তাঁর কান্নাভেজা সাংবাদিক বৈঠক গোটা দেশের ক্রীড়াপ্রেমীদের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল।


প্রতিপক্ষ তিন, নিজের দেশের কুস্তি সংস্থার গোঁয়ার্তুমি। যেখান থেকে বিনেশকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ৫৩ কেজি বিভাগে অলিম্পিক্সে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন অন্তিম পাংহাল। কারণ, তিনি যোগ্যতা অর্জন পর্বে নেমেছিলেন। আপনি বিনেশ ফোগত, কুস্তির আখড়ায় ভারতকে একাধিক গর্বের মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন তো কী? আপনাকেও পরীক্ষা দিতে হবে। মহাবীর ফোগতের ভাইঝি যা শুনে উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আখড়ায় কেরিয়ার কি তাহলে এখানেই শেষ?


প্রতিপক্ষ চার, হাঁটুর মারাত্মক চোট। যে কারণে তাঁর কেরিয়ার নিয়েই উঠে গিয়েছিল গুরুতর প্রশ্ন। অস্ত্রোপচার করানো ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু অস্ত্রোপচার করানো মানে ফিরে আসতে সময় লাগবে। অলিম্পিক্সে নামা নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরাল হয়ে পড়বে। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচারের পথেই হাঁটেন বিনেশ। চিকিৎসক কে ছিলেন? ডক্টর দীনশ পার্ডিওয়ালা। গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম ঋষভ পন্থকে যিনি কার্যত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।


বিনেশ অন্য ধাতুতে গড়া। ব্রিজভূষণ ও জাতীয় কুস্তি সংস্থার প্রশাসকদের রক্তচক্ষুও যাঁকে টলাতে পারেনি। ৫৩ কেজি বিভাগের দরজা বন্ধ তো কী! বিনেশ সিদ্ধান্ত নেন ৫০ কেজি বিভাগের জন্য নিজেকে তৈরি করবেন। সেই মতো কমিয়ে ফেলেন নিজের ওজন। কিন্তু কুস্তির হাল হকিকত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল প্রত্যেকেই জানেন যে, ওজন কমিয়ে নেমে ফেলা কতটা কঠিন। কারণ, ওজন কমানোর অর্থ বদলে ফেলতে হবে কুস্তির মারপ্যাঁচের কৌশল। 


কীরকম সেই চ্যালেঞ্জ? ধরুন বিরাট কোহলি আজীবন ব্যাট হাতে ম্যাচ জিতিয়ে এসে শুনলেন যে, এরপর থেকে দলে জায়গা পেতে হলে তাঁকে নতুন বলে বোলিংও করতে হবে। বিনেশ অবশ্য সেই অসম পরীক্ষাতেও পিছু হটেননি। যাঁকে যন্তর মন্তরের ধর্না থেকে সরাতে কার্যত একটা বাহিনি লেগে গিয়েছিল, তাঁর সংকল্প যে কী বজ্রকঠিন, টের পেয়েছেন জাতীয় কুস্তি সংস্থার পরিচালকেরাও। বিনেশ নিজে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে ওজন কমানো নিয়ে সতর্ক করেছিলেন। শরীরে নানারকম সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবু লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন হরিয়ানার পালোয়ান।


অলিম্পিক্সে কেরিয়ারে সম্পূর্ণ নতুন বিভাগে বিনেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নেমেছেন অবাছাই হিসাবে। যে কারণে বাছাই তালিকার সুবিধা পাননি। শুরুতেই দিতে হয়েছিল অগ্নিপরীক্ষা। পড়তে হয়েছিল বাঘিনীর মুখে। বাঘিনীই বটে! জাপানের ইউয়ি সুসাকি (Yui Susaki) শুধু গত অলিম্পিক্সের সোনাজয়ী নন, কেরিয়ারে ৮২টি ম্যাচ টানা জিতে নেমেছিলেন। আন্তর্জাতিক কোনও ম্যাচে হারেননি। যিনি গোটা কেরিয়ারে হেরেছেন মোটে তিনটি ম্যাচ। সেটাও স্বদেশীয় ইউকি ইরি-র কাছে। অ্যাসিড টেস্টে অবশ্য সসম্মানে উত্তীর্ণ বিনেশ। জাপানি প্রতিপক্ষকে হারিয়ে হয়তো চলতি অলিম্পিক্সের অন্যতম বড় অঘটন ঘটান। ৬ মিনিটের ম্যাচে ৫ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত ০-২ পিছিয়ে থেকেও শেষ ১৫ সেকেন্ডের আক্রমণের ঝড়ে ম্যাচ জিতে নেন বিনেশ।


তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোয়ার্টার ফাইনালেও জেতেন বিনেশ। ভারতীয় সময় মঙ্গলবার রাত সাড়ে দশটায় সেমিফাইনালে কিউবার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে প্রথম ভারতীয় মহিলা কুস্তিগীর হিসাবে ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছেন বিনেশ। পদক নিশ্চিত। শুধু পদকের রং রুপোলি হবে না সোনালি, নির্ধারিত হবে বুধবার মাঝরাতে।


কাকা ও কোচ তথা বিখ্যাত পালোয়ান মহাবীর ফোগত থেকে শুরু করে সতীর্থ বজরঙ্গ - বিনেশের জয়ে উল্লসিত সকলে। এক সুরে জানিয়ে দিয়েছেন, বিনেশের সাফল্য আসলে ব্রিজভূষণের 'গালে থাপ্পড়'। বিনেশ অবশ্য নীরব। পদক নিশ্চিত করেও আবেগকে বশ মানিয়েছেন। পেশাদারিত্বের বর্মে মুড়ে রেখেছেন নিজেকে।


হয়তো সব আবেগ বাঁধ ভাঙবে বুধবার মধ্যরাতে পদক গলায় ঝোলানোর পর। হয়তো প্রতিকূলতা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেবেন। হয়তো দেবেন না। তাঁর হয়ে জবাব দেবে তাঁর কীর্তি।


আর বিনেশের চোখের কোণ চিকচিক করবে। যে নোনা জলে মিশে থাকবে সমপরিমাণ আনন্দ ও যন্ত্রণা। ব্যাকগ্রাউন্ডে কি বেজে উঠবে, নয়না, যো মিলকে রাত জাগতে থে নয়না...


আরও পড়ুন: ভারতের মাটিতে ফের এক বিশ্বকাপ? বাংলাদেশের বিকল্প ভেন্যু হিসাবে কী ভাবনা আইসিসি-র?


আপনার পছন্দের খবর আর আপডেট পাবেন আপনার পছন্দের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম হোয়াটস অ্যাপেও। যুক্ত হোন ABP Ananda হোয়াটস অ্যাপ চ্যানেলে।